দোতলা এই স্কুলভবনটির এখন অস্তিত্বই নেই। ফাইল চিত্র
বিদ্যুৎ, সড়ক, স্বাস্থ্য কেন্দ্র নেই। চরে নেই রাজ্যে আছে তবু কয়েকটি প্রাথমিক স্কুল। কিন্তু সে স্কুলে পড়ান যাঁরা তাঁদের মান সম্মান নিয়ে এ বার টানাটানি শুরু হয়েছে।
চর নারুখাকি গ্রাম ২০১৩ সালেই নিশ্চিহ্ন হয়েছে পদ্মাগর্ভে। চর গোঠা ও চর জোত বিশ্বনাথপুর পদ্মায় মিশে গেছে ২০১৪ সালে। তিনটি গ্রামই ছিল রঘুনাথগঞ্জ ২ ব্লকের বড়শিমুল গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনে। ভিটে মাটি হারিয়ে আজ কয়েকশো পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন পদ্মা ছাড়িয়ে অ্যাফ্লেক্স বাঁধ ও তার আশপাশে। চালচুলোহীন কিছু মানুষ বসত গেড়েছেন চর হঠাৎপাড়ায়। হয়ত হঠাৎ গজিয়ে ওঠা চরে কোনও রকমে বসতের সন্ধান মেলাতে এমন নামকরণ। এই চরের জোত বিশ্বনাথপুর প্রাথমিক স্কুলে টানা ১৮ বছর শিক্ষকতা করে অবসর নিয়েছেন প্রাণাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়। চর জীবনের অভিজ্ঞতার ঝুলি তার পরিপূর্ণ। কখনও চরের গাছতলা, কখনও গ্রামবাসীর বারান্দায় বসে স্কুলে চলেছে তাঁর। নিজেই সরকারি অর্থে এক সময় গড়ে তুলেছেন প্রাথমিক স্কুলের দ্বিতল পাকা ভবন। আর তারই চোখের সামনে বছর ছয়েকের মধ্যেই সেই দ্বিতল পাকা ভবনকেই গ্রাস করেছে উন্মত্ত পদ্মা। স্কুলের ঠাঁই হয়েছে গাছতলায়। গত বছর হঠাৎপাড়াতেই তৈরি হয়েছে এক তলা আইসিডিএস কেন্দ্র। এখন সেই ভবনেই সকালে চলে আইসিডিএস কেন্দ্র। দুপুরে চলে দু-দুটি প্রাথমিক স্কুল জোত বিশ্বনাথপুর ও চর গোঠা। হ্যাঁ চর ভেসে গেলেও নাম রয়েছে একই।
জোত বিশ্বনাথপুরে ছাত্র সংখ্যা ১৪৭ আর চর গোঠায় ১৮ জন। জোত বিশ্বনাথপুর ও চর গোঠা দুটি স্কুলেই শিক্ষক সংখ্যা এক জন। সঙ্গে গ্রামেরই দু’জন পার্শ্বশিক্ষক। দুই স্কুল মিলে মিশে একাকার। দু’টি স্কুলেরই খাতায় কলমে অবস্থান বড়শিমুল গ্রাম পঞ্চায়েতে। কিন্তু বাস্তবে তা চলে সেখালিপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায়।
প্রাণাশিসবাবু বলছেন, “১৮ বছর আগে প্রথম যে দিন স্কুলে যাই সে দিনের যে অভিজ্ঞতা, এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসেও তার হেরফের হয়নি। ইংরেজিতে অনার্স পাশ করে বেকারির যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেতে প্রাথমিক শিক্ষকতার চাকরিতে যোগ দিতে কার্যত বাধ্য হয়েছিলাম। বাড়ি থেকে ১২ কিলোমিটার পেরিয়ে বাসে করে কাটাখালি পদ্মা ঘাট। সেখান থেকে নৌকা, হেঁটে প্রায় ৯ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে গ্রামে পৌঁছেছিলাম। শেষ দিনেও তাই।’’
গ্রামের ছেলেরাই নিয়ে গিয়েছিল তাঁকে। একটি বাড়ির ছোট্ট বারান্দায়। সেটাই ছিল স্কুল। কাটাখালি ঘাটে পথ আটকেছিল এক জওয়ান। প্রথম শুনতে হয়েছিল তু কৌন হ্যায় বে? শেষ দিকেও তার পরিবর্তন হয়নি বলেই জানাচ্ছেন তিনি। বলছেন, ‘‘সেই ভোটার কার্ড নিয়ে সন্দেহের চোখে তাকনো। ইংরাজিতে নাম বললে গালমন্দের পর্দা চড়ানো, দেহ তল্লাশির নামে অভভ্যতা— এ সবের কোনও বদল দেখলাম না।’’
কাটাখালির ঘাট এখনও আছে। তবে পারাপার নিষিদ্ধ। নতুন ঘাট তৈরি হয়েছে আরও এক কিলোমিটার দূরে শিশুর মোড়ে। তবে বিএসএফের চোখ রাঙানি আছে সেখানেও। শেষ দিনের অভিজ্ঞতার কথা বলতে প্রাণাশিসের চোখে জল আসে— জানেন শেষ দিনে ছাত্র-শিক্ষকদের কাছে পেলাম চটি আর ছাতা। সে সব নিয়ে যখন ঘাটে পোঁছই তখন দাঁড় করিয়ে সমানে চলল তল্লাশি। একটা গীতা ছিল, সেটা মোড়া ছিল রঙিন কাগজে। এক নিমেষে কাগজ ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে অশ্রাব্য ভাষায় গালমন্দ।’’
শিক্ষক পারভেজ আলম বলছেন, “কতদিন বোতলের জল মাটিতে ঢেলেছে জওয়ানেরা। মিডডে মিলের বস্তা বোঝাই চাল, কয়েকশো জুতো, ছাত্রছাত্রীদের পোশাক নিয়ে যেতে গিয়ে জুটেছে পাচারকারীর তকমা। ইয়ে সব বাংলাদেশ ভেজেগা কেয়া?” তিনি বলছেন, “চরের মানুষ বিএস এফের এই সব কটূক্তি শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। কারণে অকারণে চড় থাপ্পড়েও অভ্যস্ত তাঁরা।’’ তবু নদী সাঁতরে চরযাত্রার শেষ নেই।