জমে উঠেছে বাজার।—নিজস্ব চিত্র
পাল-পার্বণের শহর নবদ্বীপের ভালমন্দের সঙ্গে উৎসবের সম্পর্ক গভীর। পয়লা বৈশাখ থেকে চৈত্র সংক্রান্তি। বছরের ৩৬৫ দিনই কোনও না কোনও উৎসবের যোগ। সেই উৎসবের টানে সারা পৃথিবী থেকে মানুষ ছুটে আসেন গঙ্গার তীরের জুই জনপদ নবদ্বীপ-মায়াপুরে। আর কল-কারখানাহীন এই শহর বেঁচে থাকে উৎসবকেন্দ্রিক পর্যটনকে আঁকড়ে। শহরের বেশিরভাগ মানুষের জীবিকা ছোট-বড়, খুচরো-পাইকারি নানা রকমের ব্যবসার নির্ভরশীল।
কিন্তু রাজ্যে বিধানসভা ভোট ঘোষণার পর থেকেই নবদ্বীপের সেই ব্যবসা বাণিজ্যে আসে ভা়টার টান। দীর্ঘ দু’মাস ধরে চলা নির্বাচন প্রক্রিয়ার জেরে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল পর্যটকের আসা-যাওয়া। ফলে পর্যটননির্ভর বাণিজ্য লাটে ওঠার জোগাড় হয়। পাশাপাশি নবদ্বীপ শহরের বাণিজ্যের একটি বড় অংশের ক্রেতা আসে শহর লাগোয়া বর্ধমান জেলার গাঁ-গঞ্জ থেকে। সে সব এলাকার খুচরো পাইকারি ব্যবসায়ীদের প্রধান বাজার নবদ্বীপ। কিন্তু ভোট বা হিংসার পরিবেশ যত গড়িয়েছে, ততই গ্রামীণ এলাকা থেকে মানুষের যাতায়াত বন্ধ হয়েছে নবদ্বীপ বাজারে। যার নিট ফল দিনের পর দিন ‘বউনি’ ছাড়াই দোকান বন্ধ করতে হয়েছে বহু ব্যবসায়ীকে।
নবদ্বীপ ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক নিরঞ্জন দাস বলেন, “এই দীর্ঘ ভোটপর্বে একটা জিনিস ব্যবসায়ীরা পরিষ্কার বুঝতে পারেন, ভোট না মিটলে এই মন্দার হাত থেকে রেহাই নেই।” তাই ভোট শেষে বাজার চাঙ্গা হওয়ার অপেক্ষায় দিন গুনছিলেন সকলে।
কিন্তু আদৌ কতটা চাঙ্গা হয়েছে বাজার? উত্তরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া মেলে ব্যবসায়ীদের থেকে। পর্যটন ব্যবসায়ীরা জানান, ভোটের ফল বের হতেই পর্যটকের দল আসতে শুরু করেছেন নবদ্বীপ-মায়াপুরে। হোটেল ব্যবসায়ীদের কথায় সেই দোলের পর ভোট ভোট করে কার্যত হোটেল অতিথিশালা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। মে মাসের ১৯ তারিখ ভোটের ফল ঘোষণা হতেই ফের হোটেলে হোটেলে চেনা ব্যস্ততা।
এ বিষয়ে হোটেল মালিক সংগঠনের মায়াপুর শাখার সম্পাদক প্রদীপ দাস বলেন, “গত দু’মাসে পর্যটকদের টিকিটিরও দেখা মিলছিল না। কিন্তু ভোট মিটতেই পর্যটকেরা আসতে শুরু করেছেন।’’ ইস্কনের জন সংযোগ আধিকারিক রমেশ দাস বলেন, “ভিনরাজ্যের পর্যটকদের ভিড়ই বেশি।”
শহরের মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী লালমোহন মোদক বলেন, “ভোট পর্বে ব্যবসা বাণিজ্যের হাল এতই খারাপ হয়েছিল যে, দিনে মাত্র পনেরো কেজি মিষ্টিও বিকোচ্ছিল না। বাজারে চাহিদা না থাকায় দুধের দাম প্রতি কেজি ১৫-১৬ টাকায় নেমে এসেছিল। অথচ সাধারণ সময়ে একশো কেজির ছানার মিষ্টি বিক্রি হয়।” তিনি জানিয়েছেন নবদ্বীপে ফের বহিরাগত মানুষ আসতে শুরু করতেই বাজারে দুধের দাম ৩০ টাকা ছাড়িয়েছে। বেড়েছে লালমোহনবাবুর মিষ্টি তৈরির পরিমাণও।
নবদ্বীপ ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক নিরঞ্জন দাস কিন্তু জানান, সার্বিক ভাবে বাজারের মন্দা আদৌ কাটেনি। তাঁর কথায়, “ভোট মিটেছে, নতুন সরকার গঠন হয়ে গিয়েছে। তারপরেও বাজার কেন চাঙ্গা হচ্ছে না তা বুঝতে পারছি না।” তার কথায় সবচেয়ে খারাপ অবস্থা পোশাক ব্যবসার। নবদ্বীপের রেডিমেড এবং বিশেষ করে লুঙ্গির বিরাট বাণিজ্য হয়। এ বারে কী খুচরো কী পাইকারি কোনও বাজারই শুরু হয়নি। এই লক্ষণকে ভাল ইঙ্গিত বলে মনে করছেন না ব্যবসায়ীরা।
রেডিমেড বস্ত্র মোহন রায় বলেন, “গত ফাল্গুন মাস থেকেই ব্যবসার এই মন্দা চলছে। প্রথমে মাধ্যমিক, উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষা। তারপর প্রবল গরম। এবং সবশেষে ভোট। মানুষ নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া দোকান মুখো হয়নি। ফলে ব্যবসা লাটে ওঠার যোগাড়।” কিন্তু এখন কি অবস্থা কিছুটা ফিরেছে? তাঁর উত্তর এমনিতে জামাইষষ্ঠীর পর বাজারে একটা মন্দা ভাব আসে। বৃষ্টি নামলেই বাজার পড়ে যায়। পুজোয় গিয়ে সেই বাজার ওঠে। কিন্তু এবার বৃষ্টিও আগে নেমে পড়েছে। অর্থাৎ ধারাবাহিক মন্দায় কোন ছেদ না পড়লেও সামনে জামাইষষ্ঠীকে ঘিরে বাজার কিছুটা হলেও তেজি হবে এই আশাতেই আছেন ব্যবসায়ীরা।
নবদ্বীপের বস্ত্র ব্যবসায়ী দীপক মোদক অবশ্য জানান “গত কয়েক দিনে কিছুটা হলেও বাজারে একটু একটু করে কেনাবেচা শুরু হচ্ছে। মনে হচ্ছে জামাইষষ্ঠী বাজার নেহাত খারাপ যাবে না।”
লক্ষ্মী নয়, আপাতত ষষ্ঠীতেই ভরসা রাখছেন ব্যবসায়ীরা।