নিজস্ব চিত্র
ফ্লাডলাইটের কেরামতি রাতকে যেন দিন করে দিয়েছে। নবদ্বীপ কর্মমন্দিরের মাঠ ভেসে যাচ্ছে সেই আলোর দোলনায়। লেজারের আলো দর্শকদের দিকে ঘুরলেই গর্জে উঠছে গোটা মাঠ—‘লেটস ফুটবল’!
আর এ ভাবেই রবিবার নবদ্বীপে শুরু হয়ে গেল এক মাস ব্যাপী ‘মিউনিসিপ্যাল সকার কাপ-সিজন থ্রি।’ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পরতে পরতে ছিল চমক।
যেমন, লেজার শো শেষ হতেই দর্শকদের মধ্যে পিন পড়ার স্তব্ধতা। তার পরেই আকাশ আলো করে
এক এক করে উড়তে শুরু করল অসংখ্য ফানুস।
নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না সকার কাপের প্রথম ম্যাচ দেখতে মাঠে আসা নবদ্বীপ ও লাগোয়া এলাকার অসংখ্য দর্শক।
সকার-কাপের উত্তেজনা ধরা পড়েছিল বেশ কিছু দিন আগে থেকেই। গোছা গোছা রঙিন লিফলেট হাতে দলবেঁধে শহরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে একদল ছেলে —এ দৃশ্য দেখে হতবাক হয়েছিলেন অনেকেই। সামনে যে ভোট-ঠোট নেই। তা হলে? লিফলেট হাতে পেয়ে বুঝেছিলেন এই প্রচার নিছকই ফুটবলের জন্য। এমনকী সকার কাপের উন্মাদনার কাছে ক্রমশ পিছিয়ে পড়েছিল নোট বাতিল সমস্যা। আর আজ তা আরও স্পষ্ট হয়ে গেল। কোথায় পাঁচশো-হাজারের হাহাকার? বরং সকলের চোখ আটকে বাইশ জোড়া বুটে।
সময় যতই এগিয়েছিল, শহরের দখল নিয়েছিল ফুটবল। ক্লাবঘর থেকে পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকান কিংবা রাস্তাঘাট, কান পাতলে শোনা যাচ্ছে ফুটবলের ভালমন্দ নিয়ে নানা কথা। নোট বাতিল পরবর্তী ডামাডোলের এই বাজারে কে কেমন দল গড়ছে, আলোচনা মূলত তা নিয়েই।
এমনিতেই নবদ্বীপ মিউনিসিপ্যাল স্পোর্টস আকাডেমির ব্যবস্থাপনায় সকার কাপের তৃতীয় বছরে অংশগ্রহণকারী দলের সংখ্যা ১৬ থেকে বেড়ে ২৪ হয়েছে। একটা মফস্সল শহরের দু’ডজন ক্লাব এই মাপের একটা ফুটবল প্রতিযোগিতায় অংশ নিলে যেমনটি হওয়ার কথা, নবদ্বীপে তেমনটাই হচ্ছে। আগামী এক মাস ধরে চলা সকার কাপকে ঘিরে উন্মাদনার পারদ কোন পর্যায়ে চড়তে পারে, তা গত দু’বছরেই মালুম হয়েছে। এ বার তো আয়োজনেও অনেক নতুন চমক রাখছেন উদ্যোক্তারা। তার মধ্যে মানুষ সব চেয়ে বেশি উত্তেজিত নৈশালোকে ফুটবল নিয়ে। কিন্তু তা বলে ‘সিজন থ্রি’তে এসে নবদ্বীপবাসী যা দেখল, তা এই শহরে আগে কখনও ঘটেনি।
রবিবার সন্ধ্যায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মাঠে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় ফুটবল দলের প্রাক্তন অধিনায়ক ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়। ফুটবল শুরুর আগে এই চমক দেখে অভিভূত ভাস্করবাবুও বলেছেন, ‘‘নবদ্বীপের মতো মঠ-মন্দিরের শহরেও যে এ ভাবে ফুটবল হয়, তা এখানে না এলে বিশ্বাসই হত না।’’
প্রথম খেলায় মুখোমুখি হয়েছে কল্যাণ সমিতি ও দ্য নিউ ক্লাব। নৈশ ফুটবল দেখতে মাঠে পিলপিল করে লোক ঢুকতে শুরু করেছিল সেই বিকেল থেকে। প্রথমার্ধ্বের খেলা শেষ হওয়ার পরেই মাঠে লোক আসার বিরাম ছিল না।
ফুটবল নিয়ে নবদ্বীপের ক্লাবগুলির এই মাতামাতি বা শহর জোড়া উন্মাদনা দেখে শহরের প্রবীণ ফুটবলার রঞ্জিত মুখোপাধ্যায়, অর্জুন কর্মকার বা শিবপ্রসাদ ঘোষালেরা বলছেন, ‘‘ছয় বা সাতের দশকে আমরা যখন খেলেছি, তখন ফুটবলে এমন টাকার ছড়াছড়ি ছিল না। তবে ভাল টিম করার জন্য ক্লাবকর্তাদের ছোটাছুটি বা খেলাপাগল সমর্থকদের উন্মাদনা ঠিক এই রকমই ছিল। সকার কাপ সেই উন্মাদনা আবার ফিরিয়ে দিয়েছে। প্রচুর মানুষ আবার মাঠে যাচ্ছেন।’’
একই সুরে নবদ্বীপ জোনাল স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক জয়ন্ত গোস্বামী বলেন, “দীর্ঘদিন নবদ্বীপের খেলাধুলোর সঙ্গে জড়িয়ে থাকার অভিজ্ঞতা থেকে জানি, লিগের খেলায় মেরে কেটে মাঠে পঞ্চাশ জন হয়। তার মধ্যে ২২ জন খেলোয়াড় আর বাকিরা ক্লাবকর্তা। সেখানে প্রতি দিন চার-পাঁচ হাজার দর্শক, স্রেফ ভাবাই যায় না।”