পাকশালা: চলছে রান্না। —নিজস্ব চিত্র।
রান্নাঘরে রাজসূয়।
লালমোহন গঙ্গোপাধ্যায় ওরফে জটায়ুর ‘সাম্প্রতিকতম’ উপন্যাসের নাম হতেই পারত এটা। দোলের পনেরো দিন নবদ্বীপ কোলেরডাঙ্গায় কেশবজী গৌড়ীয় মঠের রান্নাঘরে তিন বেলার আয়োজনের বহর দেখলে এমন নাম না রেখে উপায়ও নেই।
কিন্তু কী এমন রান্না? উত্তরে মন্দিরের পাকশালার দায়িত্বপ্রাপ্ত বাবাজী মহারাজ বললেন, “পরিক্রমা শুরু হওয়ার আগের দিন থেকে দোলের পরের দু’দিন, এই দশ দিন ধরে প্রতি দিন তিন দফা খাবারের আয়োজন করতে হয়। এ জন্য প্রতি দিন লাগে ৪৫ কুইন্ট্যাল চাল, ১৮ কুইন্ট্যাল সবজি, ৩ কুইন্ট্যাল আটা, পায়েসের জন্য ৮ কুইন্ট্যাল দুধ এবং সেই অনুপাতে আদা লঙ্কা অনান্য মশলা। এই ক’দিনে কুড়ি কেজির সরষের তেলের টিন লাগে ৪৫ থেকে ৫০টি। সঙ্গে আবার সাদা তেল।”
চমকে যাওয়ার মতোই ব্যাপার। এ ছাড়াও আছে প্রায় হাজার খানেক বিদেশি ভক্তের জন্য আলাদা রান্নার ব্যবস্থা। মূল রান্নাঘরের দায়িত্ব ওড়িশার ত্রিলোচন পাণ্ডার। বালেশ্বরের বাসিন্দা ত্রিলোচন এবং তাঁর ১৮০ জন সাঙ্গপাঙ্গ কেশবজী গৌড়ীয় মঠে দোল উপলক্ষে যে দু’টি কড়াইয়ে রান্না করছেন, তার একটায় দশ কুইন্ট্যাল এবং অপরটিতে ন’কুইন্ট্যাল জিনিস এক-একবারে রান্না হয়। পুকুরের মত কড়াইয়ে ওই বিপুল পরিমান শাক-সব্জি ঠিক মতো নাড়াচাড়া করতে কম পক্ষে দু’টি করে খুন্তি ব্যবহার করতে হয়, যার প্রতিটি ৪৫ কেজি ওজনের। রোজ গড়ে বিশ হাজার লোকের জন্য তিন বার করে রান্না করছেন ওঁরা। সকালের জলখাবার, দুপুর আর রাতের খাওয়া মিলিয়ে রোজ ৬০ হাজার প্লেট।
মঠে রোজ সকালের জলখাবারে একটিই পদ— সব্জি ও খিচুড়ি। তার জন্য বরাদ্দ পাঁচ কুইন্ট্যাল চাল, চার কুইন্ট্যাল ডাল, আলু চার কুইন্ট্যাল, টম্যাটো আড়াই কুইন্ট্যাল ও তিন টিন সরষের তেল। দুপুরের সাদা ভাত পনেরো কুইন্ট্যাল, রান্না করা মুগডাল চার কুইন্ট্যাল। একটা সব্জির পদ।
তাতে থাকছে আলু ৮ কুইন্ট্যাল, ৬ কুইন্ট্যাল মিষ্টি কুমড়ো, বাঁধাকপি আর পেঁপে ৩ কুইন্ট্যাল করে, বেগুন ২ কুইন্ট্যাল, মুলো আর ফুলকপি ১ কুইন্ট্যাল করে, ফুলকপি ১ কুইন্ট্যাল এবং পুঁই শাক ৩ কুইন্ট্যাল। মোট ২৮ কুইন্ট্যাল। আড়াই কুইন্ট্যাল চিনি দিয়ে তৈরি ছয় কুইন্ট্যাল টম্যাটোর চাটনি। আর শেষ পাতে পায়েস। সে জন্য প্রতিদিন এক হাজার লিটার দুধ, ২ কুইন্ট্যাল গোবিন্দভোগ চাল, আড়াই কুইন্ট্যাল চিনি এবং ৬০ কেজি খেজুরের গুড়। রাতের মেনুও একই রকম। সঙ্গে আশি কেজি হাতে গড়া আটার রুটি।
ত্রিলোচন পান্ডা পঞ্চাশ জন হালুইকর নিয়ে রান্না করেন। মহাদেব জানা আশি জনকে নিয়ে কোটাবাটা এবং পরিবেশনের কাজটি করেন। মঠের ঘড়িতে রাত ২টো বাজতেই শুরু হয় রান্নার প্রস্তুতি। রাক্ষুসে রান্নাঘরে এক সঙ্গে সত্তর-আশিটা বঁটিতে ঝড়ের গতিতে কোটা হচ্ছে কুইন্ট্যাল কুইন্ট্যাল সব্জি।
দুই হর্সপাওয়ারের মোটর চালিত বিশেষ পেশাই যন্ত্রে বাঁটা আদা, কাঁচালঙ্কা। পঞ্চাশ কেজি কাঁচালঙ্কায় দেড় দিন চলে। ছোট পাম্পের সঙ্গে পাইপ লাগিয়ে ধোয়া হয় কাটা সব্জি আর চাল-ডাল। রাত তিনটে নাগাদ ময়দানে নামেন হালুইকরের দল। ত্রিলোচন পাণ্ডা ধরিয়ে ফেলেন প্রকাণ্ড উনুন। যার জন্য প্রথম বারেই দরকার দশ মণ কাঠ।