মেদিনীপুর সরকারি লাইটপোস্টে তৃণমূল ও বামেদের প্রচার। —নিজস্ব চিত্র
ভোটের মরসুম এখন নির্বাচনী বিধিভঙ্গ নিয়ে সরগরম। আর এ প্রশ্নে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় বাকি দলগুলিকে পিছনে ফেলে দিয়েছে তৃণমূল!
জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর, লোকসভা ভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণা হওয়ার পর থেকে এখনও পর্যন্ত যে সব অভিযোগ জমা পড়েছে, তার বেশিরভাগটাই তৃণমূলের বিরুদ্ধে। অভিযোগের প্রেক্ষিতে নোটিসও পাঠানো হয়েছে। এখনও পর্যন্ত তৃণমূলের বিরুদ্ধে আদর্শ আচরণবিধি লঙ্ঘনের ৬৭টি অভিযোগ দায়ের হয়েছে। পুলিশ মামলা রুজু করেছে। কোনও মামলায় অভিযুক্ত দলের ব্লক সভাপতিই। কোনও মামলায় আবার স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। অন্য দিকে, বামেদের বিরুদ্ধে ২২টি, বিজেপির বিরুদ্ধে ১৩টি এবং কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ১৩টি অভিযোগ দায়ের হয়েছে। এই সব অভিযোগের প্রেক্ষিতেও পুলিশ মামলা রুজু করেছে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর, বিধি লঙ্ঘনের জন্য এখনও পর্যন্ত সব মিলিয়ে জেলায় ১,২১৯টি নোটিস দেওয়া হয়েছে। রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক (সি ই ও) সুনীল গুপ্তর দফতর থেকে জেলায় ২৫টির মতো অভিযোগের প্রতিলিপি আসে। যে সব অভিযোগগুলো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা সরাসরি সিইও-র দফতরে পাঠান। সব অভিযোগ খতিয়ে দেখে দ্রুত পদক্ষেপ করা হয়েছে।
ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণার পর জেলা এবং ব্লকস্তরে সর্বদল বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে নির্বাচনী আদর্শ আচরণবিধি সম্পর্কে সমস্ত কিছুই জানানো হয়েছে। স্থানীয় নেতা-কর্মীদের জানানো হয়েছে, ভোট-প্রচারে কী করা যাবে, কী করা যাবে না। কী করলে বিধি লঙ্ঘিত হবে। তারপরও একের পর একে বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠায় নানা মহলে প্রশ্ন উঠছে। জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর, তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিধি লঙ্ঘনের শেষ অভিযোগটি উঠেছে গত রবিবার। ওই দিন মেদিনীপুরের তৃণমূল প্রার্থী সন্ধ্যা রায়কে নিয়ে দলীয় নেতৃত্ব সদর ব্লকের চাঁদড়ায় এক কর্মিসভা করেন। কর্মিসভাটি হয় স্থানীয় স্কুল ক্যাম্পাসে। প্রয়োজনীয় অনুমতি ছাড়াই চাঁদরায় কর্মিসভার আয়োজন করা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে অভিযোগের প্রেক্ষিতে পুলিশ মামলা রুজু করেছে। সপ্তাহ খানেক আগে সদর ব্লকের পাঁচখুরিতে তৃণমূলের এক কর্মিসভা হয়। সভাটি হয় স্থানীয় মার্কেট কমপ্লেক্সে। এটি সরকারি জায়গা। সরকারি জায়গায় সভা করার জন্যও পুলিশ মামলা রুজু করে।
প্রয়োজনীয় অনুমতি না-নিয়ে চাঁদরায় কর্মিসভা হল কেন? জেলা তৃণমূলের চেয়ারম্যান মৃগেন মাইতির জবাব, “ঠিক কী হয়েছে দেখছি। অনুমতি তো নেওয়ার কথা!” তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে যে ভুলত্রুটি হচ্ছে, তা মানছেন মৃগেনবাবু। তিনি বলেন, “কর্মীদের আদর্শ আচরণবিধি মেনেই প্রচার-কর্মসূচি সংগঠিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও সামান্য ভুলত্রুটি হতে পারে। ভুল হয়ে থাকলে সংশোধন করা হবে।” আদর্শ আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে বামেদের বিরুদ্ধেও। সিপিআইয়ের জেলা সম্পাদক তথা ঘাটালের বাম প্রার্থী সন্তোষ রাণারও বক্তব্য, “কিছু ক্ষেত্রে সামান্য ভুল হতে পারে। আমরা শুধরে নিচ্ছি।” বিজেপির জেলা সভাপতি তুষার মুখোপাধ্যায় বলেন, “আমরা আচরণবিধি মেনেই প্রচার-কর্মসূচি করছি। কিছু ক্ষেত্রে হয়তো ভুল হয়েছে। সে ক্ষেত্রে সংশোধনও করা হয়েছে। আচরণবিধি মেনে প্রচার করতে কর্মীদের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।”
হাবরা ও হাওড়ার ঘটনার পর বিডিওদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুরে। রীতিমতো চিঠি পাঠিয়ে বিডিওদের জানানো হয়েছে, কোনও সম্পত্তি বিকৃত হয়েছে দেখলে তাঁরা প্রয়োজনে শো-কজ নোটিস পাঠাতে পারেন। পুলিশে লিখিত অভিযোগও দায়ের করতে পারেন। জেলায় তিনটি লোকসভা কেন্দ্র রয়েছে। মেদিনীপুর লোকসভার রিটার্নিং অফিসার (আর ও) হয়েছেন জেলাশাসক গুলাম আলি আনসারি। ঘাটাল লোকসভার রিটার্নিং অফিসার অতিরিক্ত জেলাশাসক সুশান্ত চক্রবর্তী ও ঝাড়গ্রামের রিটার্নিং অফিসার হয়েছেন অতিরিক্ত জেলাশাসক আর অর্জুন। জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর, তিন রিটার্নিং অফিসারই চিঠি দিয়ে নিজের নিজের এলাকার বিডিওদের এ কথা জানিয়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ এ বার থেকে বেআইনি দেওয়াল লিখন বা পোস্টার-ফেস্টুন নিয়ে কাউকে শো-কজ বা কারও বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করতে হলে আর জেলার দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। প্রয়োজন মনে হলে বিডিওরাই পদক্ষেপ করতে পারেন।
উত্তর ২৪ পরগনার হাবরার ঘটনা নিয়ে রাজ্যে এখনও জলঘোলা চলছে। এ ক্ষেত্রে তৃণমূলের পোস্টার সরাতে গিয়ে হেনস্থার শিকার হন খোদ বিডিও। ঘটনার পরপর সরকারি আধিকারিকেরা নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। জেলাশাসকের কাছে তাঁরা নিরাপত্তাও চান। হাবরার ঘটনার পর অবশ্য উত্তর ২৪ পরগনার সব বিডিওকে নিরাপত্তারক্ষী দেওয়া হয়েছে। হাওড়ার শিবপুরে আবার বেআইনি পতাকা-ফেস্টুন খুলতে গিয়ে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের হাতে আক্রান্ত হয়েছেন সরকারি কর্মীরা। যে ঘটনা নিয়েও রাজ্যে এখনও জলঘোলা চলছে।পশ্চিম মেদিনীপুরেও কিছু এলাকায় সরকারি কর্মীদের চোখ রাঙানির মধ্যে পড়তে হয়েছে। বিরোধীদের দাবি, জেলায় ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ নেই। দাবি উড়িয়ে অবশ্য তৃণমূলের জবাব, জেলায় ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশই রয়েছে। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিডিও বলেন, “আর ও-র চিঠি পেয়েছি। এর ফলে, কাজ করতে সুবিধে হবে।”