প্রার্থনার সময় ছাত্রীদের শোনানো হচ্ছে ডেঙ্গি সচেতনতার পাঠ। ঘাটাল বসন্তকুমারী বালিকা বিদ্যালয়ে কৌশিক সাঁতরার তোলা ছবি।
এতদিন প্রার্থনার সময় স্কুলের মেয়েরা জাতীয় সঙ্গীত গাইত। তার পরেই শুরু হত পঠনপাঠন। দিন কয়েক হল ছবিটা পুরোপুরি বদলে গিয়েছে ঘাটাল শহরের বসন্ত কুমারী বালিকা বিদ্যালয়ে। এখন প্রার্থনার আগে ডেঙ্গি সচেতনতার পাঠ হচ্ছে ওই স্কুলে। আবার ক্লাসে গিয়ে পড়াশোনা শুরু আগেও ডেঙ্গি থেকে বাঁচার উপায় সম্পর্কে সচেতন করা হচ্ছে ছাত্রীদের। ফলও মিলেছে হাতেনাতে। বাড়ি ফিরে ওই পড়ুয়ারা রীতিমতো শাসন করছে পরিবারের লোকেদের। স্কুলের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে পুরসভা এবং স্বাস্থ্য দফতর।
বসন্ত কুমারী বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা বীণা মান্না বলেন, “সপ্তাহ খানেক আগেই প্রশাসনের তরফে ডেঙ্গি নিয়ে প্রচার চালানোর নির্দেশ পেয়েছিলাম। তারপরেই সব শিক্ষিকাকে নিয়ে বৈঠক করি। ডেঙ্গি রোধে বিভিন্ন উপায়ে প্রচার চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। এখন স্কুলে নিয়মিত স্বাস্থ্য দফতর থেকে পাঠানো ডেঙ্গি রোগ সংক্রান্ত নানা তথ্য ও বাঁচার উপায় ছাত্রীদের কাছে তুলে ধরা হচ্ছে।”
স্বাস্থ্য দফতর থেকে যে প্রচারপত্র পাঠানো হয়েছিল, সেটিকেই নিজেদের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছেন শিক্ষিকারা। ‘‘প্রিয় বন্ধুরা, ডেঙ্গি জ্বর সম্পর্কে সচেতন হওয়া দরকার...’’ বলে শুরু হচ্ছে সেই বক্তব্য। প্রতিদিন সকালে স্কুল শুরুর আগে কোনও একজন শিক্ষিকা সেটি পাঠ করছেন। তারপর সকলে জাতীয় সঙ্গীত গাইছে। প্রতিটি ক্লাসের রেজিস্টারে সাঁটিয়ে দেওয়া হয়েছে লিফলেট। ক্লাস শুরুর আগে ডেঙ্গি থেকে বাঁচার উপায়, জ্বর হলে কী কী করা উচিত পড়ে শোনাচ্ছে ক্লাসেরই ছাত্রী।
প্রধান শিক্ষিকা জানান, ওই স্কুলে মোট ১,৮৪৯জন ছাত্রী। বিভিন্ন এলাকা থেকে আসে তারা। ফলে তারা যদি বা়ড়ি ফিরে পরিজন এবং আশপাশের এলাকার বাসিন্দাদের এ সব জানায় তবে সচেতনতার পরিধি বাড়বে। পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী দেবাদৃতা পাল যেমন বলল, ‘‘বাড়িতে সন্ধে হলেই সব জানলা বন্ধ করে দিই। ফুলদানির জল রোজ বদলাতে বলেছি মা-কে। ছাদের ভাঙা টবগুলোও আমি সব উল্টে রেখেছি।’’ একাদশ শ্রেণির প্রিয়াঙ্কা পাত্র, সৃজিতা মুখোপাধ্যায়, নবম শ্রেণির সায়নি মণ্ডলরা জানাল, ‘‘বাড়িতে, পাড়ায় গিয়ে জানিয়েছি স্কুলে কী কী শেখানো হয়েছে। জমা জল পরিষ্কার করে দেওয়া, খালি গায়ে না-থাকা, মশারি টাঙিয়ে শোয়ার কথা সবাইকে বলেছি।’’
ঘাটাল শহরের ওই স্কুলে নিয়ম করে ডেঙ্গি নিয়ে সচেতনতা প্রচার চালানোর খবরে খুশি জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক গিরীশচন্দ্র বেরা। খুশি ঘাটালের মহকুমাশাসক পিনাকিরঞ্জন প্রধানও। কিন্তু সব স্কুলে নিয়ম করে এই প্রচার না-হওয়ায় ক্ষুব্ধ জেলার শিক্ষা কর্মাধ্যক্ষ শ্যাম পাত্র। তিনি বলেন, “এটা একটা জাতীয় বিপর্যয়। গোটা রাজ্য জুড়েই ডেঙ্গি হানা বাড়ছে। স্কুলে নির্দেশ না গেলেও শিক্ষকদের উচিত এই সময় রোগ সংক্রান্ত নানা তথ্য ছাত্রছাত্রীদের সামনে তুলে ধরা। সচেতনতা বাড়লেই ডেঙ্গি রোগের প্রকোপও কমবে।” শ্যামবাবু অবশ্য আশ্বাস দেন সব স্কুলে নিয়ম করে প্রচার হচ্ছে না কেন সে বিষয়ে খোঁজ নেবেন।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, পশ্চিম মেদিনীপুরে ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলছে। গড়বেতা-৩ ব্লকের সাতবাঁকুড়া পঞ্চয়েতের নবকলা, ম্যাটাডহর গ্রাম দু’টিতেই ডেঙ্গির প্রকোপ শুরু হয়। এখন বিভিন্ন ব্লকেই তা ছড়িছে। স্বাস্থ্য দফতরের তথ্য বলছে জুলাই মাস থেকে জেলায় এখন পর্যন্ত ডেঙ্গিতে মোট ৬৬ জন আক্রান্ত হয়েছেন। আর চলতি বছরের গোড়া থেকে মোট ৭১ জন আক্রান্ত হয়েছেন। বাড়ছে মশাবাহিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যাও। ঘটনায় উদ্বেগে জেলা স্বাস্থ্য দফতর।
ডেঙ্গি হানা রোধে খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সচেতনতা ও প্রচারের উপর জোর দিয়েছেন। সরকারি সব দফতরকে একযোগে প্রচারে সামিল হওয়ার নির্দেশও দিয়েছেন। অভিযোগ, সরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত স্কুলগুলিতেও স্বাস্থ্য দফতরের লিফলেট প্রচারের জন্য আর্জি জানিয়েছে শিক্ষা দফতর। স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা ক্ষোভের সুরেই বলেন, “স্কুলে বহু ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করে। এক কথায় স্কুল একটা বড় প্রচারের জায়গা। স্কুল কর্তৃপক্ষ যদি নিজেরা উদ্যোগী হয়ে প্রচার চালায় তাহলে ভাল ফল মিলবেই। কিন্তু সব স্কুলে হচ্ছে কই?”
সরকারি নির্দেশ মেনে এখন ঘাটাল পুরসভা মশানাশক তেল স্প্রে, নোংরা-আবর্জনা পরিষ্কারে জোর দিয়েছে। মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক গিরীশচন্দ্র বেরা এবং মহকুমাশাসক পিনাকিরঞ্জন প্রধানের আর্জি, “ঘাটালের বসন্তকুমারী স্কুলে যেমন নিয়ম করে এই প্রচার চালানো হচ্ছে, সব স্কুলে এই ভাবে প্রচার হলে ভাল হয়। স্কুলই হচ্ছে বড় প্রচারের মাধ্যম।”