উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতরের প্রতিমন্ত্রী বাচ্চু হাঁসদার বাড়ি। নিজস্ব চিত্র।
সবুজ ধানখেতের মাঝে কালো পিচের রাস্তা এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে কড়াইচেঁচড়া গ্রামের দোরগোড়ায়। তার পর সিমেন্টের রাস্তা। মাটির বাড়ি আর পুকুর ঘেরা গ্রামের প্রায় শেষ প্রান্তে পৌঁছেই যেন চোখ আটকে যায়। অজ পাড়াগাঁয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে একটি প্রাসাদোপম বাড়ি!
কিছু দিন আগেও এখানে নাকি সাদামাটা বাড়ি ছিল। এখন সে সব অতীত। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বাড়ির মালিক তপনের বিধায়ক বাচ্চু হাঁসদা। বিরোধীরা তো বটেই, এমনকি আশপাশের গ্রামের বাসিন্দারাও বলছেন, কৃষকের পেটে ভাত নেই, এ দিকে নেতা বাড়ি হাঁকাচ্ছে। ‘উন্নয়ন’ কোথায় হচ্ছে, তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।”
কৃষকদের অসন্তোষের ক্ষোভে আর জেলায় নেতাদের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে এলোমেলো হয়ে গিয়েছে তৃণমূলের নির্বাচনী প্রচার। অর্পিতা ঘোষের সভায় ভিড় জমছে না। যাঁরা ভিড় করবেন, তাঁরাই তো মুখ ফিরিয়ে রয়েছেন। এলাকায় ইতিউতি অভিযোগ, এক শ্রেণির নেতার লাফিয়ে লাফিয়ে সম্পদবৃদ্ধিও সাধারণ মানুষের মনে ছাপ ফেলেছে।
আরও পড়ুন: গোটা গাঁধীনগরে একটা ছবিও নেই, আডবাণীকে শুধু পাওয়া গেল বিজেপি অফিসে প্রেস রুমের দেওয়ালে
এ রাজ্যের চাষিদের জন্য নানাবিধ প্রকল্প চালু করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগ সত্ত্বেও বাস্তবে কৃষকেরা তার কতটা সুবিধা পেয়ে থাকেন?
দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট, কুমারগঞ্জ, তপন, গঙ্গারামপুর, হরিরামপুর, কুশমণ্ডি ব্লকের অধিকাংশ চাষির অভিজ্ঞতা অবশ্য খুব একটা ভাল নয়।
আরও পড়ুন: বাংলায় এখন শুধুই বোমার কারখানা, কালিম্পঙে মমতাকে তোপ অমিত শাহের
রাজ্য সরকারের ঠিক করে দেওয়া নিয়মের বাইরেও স্থানীয় ভাবে চাপিয়ে দেওয়া নিয়মই ডেকে আনছে বিপদ। ফড়েদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে স্থানীয় কিছু নেতার ‘কর্মকাণ্ডে’ ফাঁপরে পড়ছে তৃণমূল। আর তার ফায়দা তুলতে লোকসভা ভোটে কয়েক কদম এগিয়ে গিয়েছে বিজেপি। পুরনো রাজনৈতিক জমি পুনরুদ্ধারে ঝঁপিয়ে পড়েছেন আরএসপি নেতারাও।
দক্ষিণ দিনাজপুর কৃষিনির্ভর জেলা। গঙ্গারামপুরের তাঁতশিল্প থেকে শুরু করে ধান-পাটচাষই বেশি হয়ে থাকে। এলাকার কৃষক কমল সাহার অবশ্য মন্তব্য: ‘‘এখানকার তুলাইপাঞ্জি চাল রাজ্য সরকারের ‘বিশ্ব বাংলা’ বিপণনকেন্দ্রে শোভা বাড়ায় ঠিকই, কিন্তু এই চাল কৃষকমান্ডিতে বেচতে গিয়ে চাষির লাঙল ভেঙে যায়!’’
তিওড়ের গ্রামের চাষি বিশু মালি কৃষকমান্ডির দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ‘‘সরকার ধানের সহায়ক মূল্য প্রতি কুইন্টাল ১৭৫০ টাকা দিচ্ছে। কিন্তু সবার জন্য এই প্রকল্প নয়। যাঁদের চাষের জমি রয়েছে, তাঁরাই একমাত্র কৃষকমান্ডিতে গিয়ে সরকারি ‘কার্ড’ দেখিয়ে ধান বিক্রি করতে পারবেন। ভাগচাষিদের সেই সুযোগ নেই।”
যাঁদের কার্ড আছে, তাঁরাও বিভিন্ন ভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন স্থানীয় ভাবে ‘সৃষ্টি’ করা নিয়মের গেরোয়। কেন? বিড়িতে শেষ টান দিয়ে বিশুর পাশে বসে থাকা দিনেশ সাহা বললেন, “ধরুন, প্রতিটি ব্লকে ২০০০ করে কৃষক সহায়ক মূল্যে ধান বেচার ছাড়পত্র পেয়েছেন। কিন্তু এখানে দিনে মাত্র ৫ থেকে ৭ জনের ধান কেনে কৃষকমান্ডিতে মিল মালিকেরা। বাকিরা অপেক্ষা করেন দিনের পর দিন। যিনি একে বারে শেষের তালিকায় থাকেন, তাঁর পক্ষে এত দিন আর অপেক্ষা করা সম্ভব হয় না। ফলে ফড়েদের কাছে ১৩ টাকা কেজি দরে ধান বেচে নগদ হাতে নিয়ে মজুরদের পাওনা মিটিয়ে তবেই বাড়ি আসে। সেই ধানই ঘুরপথে চলে যায় মিল মালিকদের কাছে।”
আরও পড়ুন: আজ থেকে শুরু ভোট পর্ব, লাভ-ক্ষতি মাপছে সব পক্ষ
দক্ষিণ দিনাজপুরের ভোটে যে এর প্রভাব পড়বে, তা ভালই বুঝতে পরাছেন জেলার নেতারাও। এখনও পর্যন্ত তেমন বড় জনসভা করতে পারেননি তৃণমূল প্রার্থী অর্পিতা ঘোষ। এখনও জেলা সভাপতি বিপ্লব মিত্র এবং শঙ্কর চক্রবর্তী গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
রাখঢাক না করেই উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতরের প্রতিমন্ত্রী বাচ্চু হাঁসদার জবাব: “সবাই স্বপ্ন দেখে সাংসদ হওয়ার। রাজনীতিতে এই লড়াইটা থাকে। এটা অস্বীকার করার জায়গা নেই। অন্যায় দাবি নয়। কিন্তু আমাদের দল চলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে। তিনি যা বলবেন, তাই হবে। ”
আরও পড়ুন: পোলিং অফিসারের সঙ্গে বিতণ্ডা, আছড়ে ইভিএম ভাঙলেন প্রার্থী, পরে গ্রেফতার
তাঁর বাড়ি নিয়ে যে এলাকায় চর্চা হচ্ছে, তা-ও বাচ্চুর কানে পৌঁছেছে। এ বিষয়ে তাঁর স্পষ্ট উত্তর: “আমি পেশায় শিক্ষক। বালুরঘাটে অনেক শিক্ষক রয়েছেন। তাঁদের তুলনায় আমার বাড়ি কিছুই নয়। আমাদের যা সম্পত্তি ছিল, অনেকেরই নেই। এ সব নিয়ে যদি বিরোধীরা কথা বলেন, আমার কিছু বলার নেই।”
আরও পড়ুন: জমি অধিগ্রহণই হয়নি, অথচ ভোট এলেই ‘বেঁচে ওঠে’ বালুরঘাটের রেল প্রকল্প