বাসে করে বাড়ি ফিরছেন কিতাবুর। নিজস্ব চিত্র।
রবিবার গোটা দিন উৎকণ্ঠার প্রহর গুনেছেন। সোমবার রাত থাকতেই ছোট একটা ব্যাগে কয়েকটা জামাকাপড় গুছিয়ে চড়ে বসেছিলেন বাসে। রেল স্টেশনে পৌঁছনোর জন্য বাসের বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল রাজস্থান সরকারই। ট্রেনে উঠেও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, সত্যি তিনি বাড়ি ফিরছেন!
বছর তিরিশের কিতাবুর বিশ্বাসের বাড়ি নদিয়ার দত্তফুলিয়ায়। প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে রাজস্থানের অজমেরের কাছে একটা জায়গায় কাজ করেন। মঙ্গলবার বিকেলে তাঁকে ফোন করতে তিনি প্রথমেই বলে উঠলেন, ‘‘আল্লার অনেক অনেক মেহেরবানি।” কিতাবুর তখনও বাসে। মধ্যমগ্রাম পেরোয়নি বাস।
ফোনেই শোনালেন কিতাবুর তাঁর অভিজ্ঞতা।
ঠিক অজমের নয়। বরং পুষ্করের কাছাকাছি একটা পোশাক তৈরির কারখানায় কাজ করেন কিতাবুর। প্রায় তিন বছর ধরে সেখানে কাজ করছেন। ২২ মার্চ জনতা কার্ফুর দিনও বুঝতে পারেননি, পরের দিনগুলোয় কী অপেক্ষা করছিল তাঁদের জন্য। কিতাবুর একা নন। রাজ্যের শ’খানেক যুবক ওই একই কোম্পানিতে দর্জির কাজ করেন। লীলাশ্যাম এক্সপোর্টস। বড় কোম্পানি। কিতাবুররা কোম্পানির কর্মী নন। ঠিকাদারের কাছে কাজ করেন। পোশাক প্রতি পয়সা মেলে। তা-ও মাস গেলে খারাপ নয়— ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকা। কিতাবুরের কথায়, ‘‘মোদীজি যে দিন কার্ফু ঘোষণা করলেন তখনও কিছু বুঝতে পারিনি। কোম্পানিও বলল, তিন-চার দিন কারখানা বন্ধ থাকবে হয়তো। তার পর খুলে যাবে। তাই আমরা কেউ বাড়ি ফেরার কথা ভাবিনি।” কিন্তু দু’দিন কাটতেই কিতাবুররা বুঝলেন বাড়ি না ফিরে কত বড় ভুল করেছেন তাঁরা।
অজমের থেকে বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় কিতাবুরের সঙ্গীসাথীরা। নিজস্ব চিত্র
পুষ্কর থেকে কিছুটা দূরে একটা পাড়ায় ভাড়া থাকেন কিতাবুর। ১০ ফুট বাই ১০ ফুট ঘর। তার মধ্যেই রান্নাবান্না। এক একটা ঘরে থাকেন তিন বা চার জন। ঘরের ভাড়া মাসে ২০০০ টাকা। লকডাউন শুরু হওয়ার পরই কাজ বন্ধ। রোজগারও বন্ধ। কিতাবুরের কথায়, ‘‘শুরুর দিকে তা-ও এক রকম ছিল। ঠিকাদার ভরসা দিচ্ছিলেন। দিনের মধ্যে এক আধবার বাইরেও বেরতো পারছিলাম।” কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত বদলাতে থাকে পরিস্থিতি।
গোটা রাজস্থান জুড়ে কড়া হতে থাকে লকডাউনের নিয়মকানুন। বাড়ি ফিরতে ফিরতে কিতাবুর বললেন, ‘‘আমাদের একটা ঘরে টিভি ছিল। সারা দিন সেই টিভিতে খবর শুনতাম। ফোনে বাড়ির খবর নিতাম।” আর কোনও কাজ নেই। বাইরে বেরনো প্রায় বন্ধ। লকডাউনের মেয়াদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে জিনিসপত্রের দাম। কিতাবুর বলেন, ‘‘আর প্রতি দিন হিসাব করতাম, কত টাকা বেঁচে আছে পকেটে। আর কত দিন চলবে জমানো টাকায়। টাকা ফুরিয়ে যাচ্ছে। এর পর?” কিতাবুর বলেন, ‘‘ঠিকাদার খুব ভাল মানুষ। সপ্তাহে ২০০ টাকা করে বাজার খরচ দিচ্ছিলেন। কিন্তু কত দিন দেবেন। তাঁরও তো কামাই নেই এক পয়সা।” সঙ্গে বাড়ির চিন্তা। কিতাবুরের বাড়িতে বাবা-মা -ভাই রয়েছেন। সংসার চলে কিতাবুরের পাঠানো টাকাতেই। বাড়িতে পাঠানোর টাকা রাজস্থানে বসেই খরচ হয়ে গিয়েছে। বাড়িতে পাঠাবেন কী?
আরও পড়ুন: কেন্দ্রীয় সহায়তা চায় তৃণমূল, বিজেপি রাজ্যে
ফোনের ও পারে আপন মনেই কিতাবুর বলে ওঠেন, ‘‘নিজের জন্য ভাবব, না বাড়ির জন্য ভাবব! কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না।” লকডাউনের দ্বিতীয় দফা থেকেই তাঁরা শুনছিলেন ট্রেনে করে বাড়ি ফেরানোর ব্যবস্থা করবে সরকার। কিন্তু সেই ট্রেনের দেখা পাওয়া যাচ্ছিল না। এমনকি রবিবার সকালের আগেও জানতেন না অজমের থেকে ট্রেন ছাড়বে বাংলার। কিতাবুর বলেন, ‘‘রবিবার বেলার দিকে শুনেই আমরা সবাই কোম্পানির মালিককে বলি।”
শেষে কিতাবুর-সহ ৪২ জন সোমবার সকালে ট্রেনে চেপে বসেন। কিতাবুর বলেন, ‘‘ট্রেনের প্রায় সব যাত্রীই অজমেরের দরগায় তীর্থ করতে গিয়েছিলেন। তারা আটকে ছিলেন। শুনেছি পরে আর একটা ট্রেন ছাড়বে। তাতে বাকিরা বাড়ি ফিরতে পারবে।” কিতাবুরের সঙ্গী সমীর দফাদার, মুস্তাক— সবাই এখন অপেক্ষায়। তাঁরা দিন গুনছেন কবে ফের ট্রেন ছাড়বে। তাঁদের হিসাবে শুধু অজমেরেই আটকে রয়েছেন প্রায় ২০০ বাঙালি শ্রমিক। সবাই মরিয়া বাড়ি ফিরতে।
আরও পড়ুন: কোন জেলায় করোনা আক্রান্ত কত, মৃত কত, তালিকা দিল রাজ্য সরকার
কিতাবুরের বাস তত ক্ষণে বারাসত পেরিয়ে গিয়েছে। তিনি স্বীকার করেন, ‘‘বাড়ি গিয়েও সমস্যা অনেক। রোজগার নেই। বাড়িতেও খাবার নেই। রেশন ভরসা। তবু ভাল পরিবারের সবাইয়ের সঙ্গে থাকতে পারব। পাড়া প্রতিবেশীদের সাহায্যে কিছু একটা হবে।” কিতাবুরের মতো এখনও রাজস্থানে আটকে থাকা সবাই জানেন বাড়ি ফিরলেও রোজগার নেই। তা-ও ফিরতে তাঁরা মরিয়া। কিতাবুর যেমন বলেন, ‘‘করোনা হোক বা না খেয়ে থাকি, আম্মা-আব্বার কাছে তো থাকব। ওখানে মরলে তো নিজের কেউ থাকবে না গোরে মাটি দিতেও।”
কিতাবুরের সঙ্গীরা যাঁরা এখন প্রহর গুনছেন বাড়ি ফেরার, তাঁরাও জানেন, ‘‘কবে কোম্পানি খুলবে তার ঠিক নেই। লকডাউন উঠলেও এখানে কাজ না থাকলে কোথায় যাব?”
তাই জীবন জীবিকার অনিশ্চয়তার মেঘ সঙ্গে নিয়েই বাড়ির দিকে কিতাবুর, আলমগির, রশিদরা।
বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় কিতাবুরের সঙ্গীসাথিরা।
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)