অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
‘ডেসিবেল’। শব্দটা কী? শহরতলির মহেশতলা, বজবজ, চম্পাহাটিতে শব্দবাজির আঁতুড়ঘরে কোনও শ্রমিকই এর মানে বোঝেন না। মজুরির বিনিময়ে ভাগ অনুযায়ী মশলা মিশিয়ে বিকট আওয়াজের চকোলেট বোমা তৈরি করাটাই তাঁদের কাজ।
চার দিক খোলা, মাথায় টালির চাল। প্রায় তিন হাজার বর্গফুট একটা জায়গা। ঘরের এক পাশে বড় বড় কয়েকটি বস্তা থেকে মশলা বার করে তা ভাগ অনুযায়ী মেশানো হচ্ছে। আর এক দিকে ছোট ছোট কাগজের বাক্সে মশলা ভরে সুতলি দড়ি দিয়ে বাঁধা হচ্ছে চকোলেট বোমা। জনা কুড়ি শ্রমিক মাথা নিচু করে কাজ করে চলেছেন। মুখে রা নেই।
সপ্তমীর ভরদুপুরে অনেক কষ্টে পৌঁছলাম সেই কারখানায়। সৌজন্য কলকাতার কয়েকটি জনপ্রিয় দুর্গাপুজোর ‘ভিআইপি পাস’।
বছর চারেক ধরে তুবড়ি কিনতে যাওয়ার সুবাদে দক্ষিণ শহরতলির ওই বাজি ব্যবসায়ীর সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছে। এ বছর পঞ্চমীর দিন ফোন করে মেয়ে-জামাইয়ের জন্য কয়েকটি নামী পুজোর পাসের আবদার জানিয়ে রেখেছিলেন তিনি। কলকাতার জনপ্রিয় কয়েকটি বড় পুজোর পাস নিয়ে তাই সপ্তমীর দিন হাজির হয়েছিলাম তাঁর আতসবাজির সেই কারখানায়।
কথায় কথায় এল বাজির শব্দমাত্রা নিয়ে হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্টে সাম্প্রতিক আইনি লড়াইয়ের প্রসঙ্গ। চকলেট বোমার ডেসিবেলের কথা তুলতে প্রায় ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন ওই ব্যবসায়ী। তাঁর কথায়— চকোলেটের প্রচুর চাহিদা। অল্প খরচ, দক্ষ শ্রমিকও দরকার নেই। সে ক্ষেত্রে আইনি বাধা চকোলেট তৈরি ও ফাটানো ঠেকাতে পারবে না। কথায় কথায় তিনি কবুলও করলেন, বৈধ আতসবাজির আড়ালে জমিয়ে চকোলেট তৈরি করেন। বিক্রিও দেদার।
কারখানা ও চকোলেট তৈরি দেখার ইচ্ছাও প্রকাশ করলাম। প্রথমে কিছুটা কিন্তু-কিন্তু। পরে ওই ব্যবসায়ী বললেন, ‘‘চলুন।।’’ রাস্তার উপরে ওই ব্যবসায়ীর বাড়ি। কিছুটা দূরে কিছু ছোট ছোট ঝুপড়ি ঘর। তার পাশ দিয়ে সরু অলিগলি হয়ে প্রায় ১০ কাঠা জমিতে চকোলেট কারখানা। সেখানে পৌঁছে প্লাস্টিকের চেয়ার এগিয়ে ওই ব্যবসায়ী বললেন, ‘‘বসুন।’’ তার পরে সোজা বললেন, ‘‘চকোলেট বোমার ব্যবসা কোনও ডেসিবেলের শব্দমাত্রার ধার ধারে না। পুলিশি তল্লাশিও তা বন্ধ করতে পারবে না। তার অনেক কারণ রয়েছে। শুনবেন?’’
শুরু হল চকোলেট-বৃত্তান্ত। ব্যবসায়ী বললেন, ‘‘চকোলেট তৈরি করতে চার রকম মশলা প্রয়োজন। সোরা, গন্ধক, অ্যালুমিনিয়াম ও বেরিয়াম। কেজি-প্রতি সোরা ৩০ টাকা, গন্ধক ১২ টাকা, অ্যালুমিনিয়াম-১৮০ টাকা ও বেরিয়াম-১৮ টাকা। এক কেজি মশলায় দু’হাজার পিস চকোলেট তৈরি হয়। সুতলি, রাংতা ও ৩০০ টাকা জনমজুরি নিয়ে দু’হাজার পিস চকোলেট তৈরি করতে ৮০০ টাকা খরচ। তৈরিতেও ঝুঁকি নেই। শুধু মশলা আগুন থেকে দূরে রাখলেই হল। চেষ্টা করলে আপনিও বাড়িতে বসে চকোলেট তৈরি করতে পারেন। আর বিক্রি? ১০০ চকোলেটের প্যাকেট ১২০ থেকে ১৫০ টাকায়। এ বার ভাবুন। ঝুঁকিহীন ব্যবসায় কত মুনাফা! সবাই করবে।’’ জিজ্ঞাসা করলাম, এ বার নাকি মহেশতলা, বজবজ চম্পাহাটিতে জোরদার পুলিশি তল্লাশি হবে? মুচকি হেসে ব্যবসায়ী বলেন, ‘‘তল্লাশি শুরুর আগেই চকোলেট তৈরি হয়ে প্যাক হয়ে যাবে। দেখছেন তো, দিন-রাত কাজ হচ্ছে। আমার কারখানায় প্রায় ৫ লক্ষ চকোলেট তৈরি হচ্ছে। বিভিন্ন বাড়ির মহিলারা তা নিয়ে যাবে। রাংতা মুড়ে, প্লাস্টিকের প্যাকেটে ভরে রেখে দেবে নিজের বাড়িতে। লক্ষ্মীপুজোর পর থেকে বাঁধা খরিদ্দারেরা সব আসবে, নিয়ে যাবে। কালীপুজোর সময়ে একটু লুকিয়ে চুরিয়ে বিক্রি করতে হবে। পুলিশ তো টুকটাক চকোলেট পায়। ওতে লাভের গুড়ে আঁচড়ও পড়ে না।’’
কথায় কথায় সন্ধ্যা নেমেছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম দু’জনেই। ফিরতি পথে ওই ব্যবসায়ী বললেন, ‘‘আমার এখানেই যদি ৫ লক্ষ চকোলেট তৈরি হয়, তা হলে ভাবুন গোটা এলাকায় কত হতে পারে! মহেশতলা, বজবজ, চম্পাহাটি, সোলগোলিয়া অধিকাংশ আতসবাজি ব্যবসায়ীই আড়ালে-আবডালে চকোলেট তৈরি করে। খরিদ্দার ‘ভগবান’। তারা ডেসিবেল বোঝে না। চকোলেটের সাউন্ডই বোঝে। যেমন আর্জি, তেমন বোমা। এটাই চকোলেট ব্যবসার আদিম রীতি।’’
বড় রাস্তায় এসে একটা অটো ডেকে এ বার আমাকে তুলে দিলেন ব্যবসায়ী। পুজোর পাসের জন্য আরও এক বার ধন্যবাদের সঙ্গে হাত ধরে ওই ব্যবসায়ী বললেন, ‘‘কালীপুজোর দিন চারেক আগে ফোন করে চলে আসবেন। আতসবাজির সঙ্গে চকোলেটও দিয়ে দেব। তেমন বর্ষা হয়নি। মশলা একেবারে শুকিয়ে তাজা। বিকট ফাটবে।’’ আসব বলে অটোয় উঠে পড়লাম।