গত ক’দিনে যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন ওঁরা!
পুলিশ সূত্রে খবর, গত কয়েক মাস ধরে ফোন করে ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডের তথ্য, পিন এবং ওটিপি (ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড) হাতিয়ে জালিয়াতির অভিযোগে নাজেহাল হচ্ছিল লালবাজারের ব্যাঙ্ক জালিয়াতি দমন শাখা। কিন্তু দিন দশেক হল নোট বদল, এটিএম থেকে টাকা তোলার মাত্রা বেঁধে দেওয়া, নেট ব্যাঙ্কিংয়ের ‘লিঙ্ক’ সমস্যা— এ সব মাথাচাড়া দিতেই ঝুপ করে যেন নেমে গিয়েছে জালিয়াতির অভিযোগের মাত্রা। এক পুলিশ অফিসারের কথায়, ‘‘এমনও হয়েছে যে আগে এক দিনে এক ডজন অভিযোগ এসেছে। কিন্তু গত তিন দিনে একটিও আসেনি!’’
পুলিশ বলছে, ফোন করে ব্যাঙ্ককর্মী পরিচয় দিয়ে গ্রাহকের কাছ থেকে কার্ডের তথ্য (নম্বর, মেয়াদ ফুরনোর দিন, সিভিভি নম্বর) এবং লেনদেনের সময় পাঠানো ওটিপি হাতিয়ে নেয় জালিয়াতেরা। তার পরে তা দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। এই জালিয়াতির অধিকাংশ গ্যাংয়ের সদস্যেরা মূলত ঝাড়খণ্ডের কর্মটাঁড়, জামতাড়া এলাকার বাসিন্দা। লালবাজারের গোয়েন্দাদের মুখে তাই এ ধরনের দুষ্কৃতীদের নাম জামতাড়া গ্যাং। তবে গত ক’দিনে ‘ব্যাঙ্কের’ ফোনও যে তেমন আসছে না, আমজনতার অভিজ্ঞতাই তা বলছে।
নোট বদলের সঙ্গে ওই জালিয়াতদের নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ার সম্পর্ক কী?
লালবাজারের একাংশের ব্যাখ্যা, জালিয়াতি করে টাকা প্রথমে অনলাইন ওয়ালেটে এবং সেখান থেকে ভুয়ো তথ্য দিয়ে তৈরি করা বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে সরিয়ে নিত জালিয়াতেরা। তার পরে এটিএম কার্ড ব্যবহার করে টাকা তুলে নিত। কিন্তু পাঁচশো এবং হাজার টাকার নোট বাতিল হওয়ার পরে এটিএম থেকে টাকা তোলার মাত্রা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। ফলে জালিয়াতি করে টাকা হাতালেও তা তড়িঘড়ি তুলতে পারা যাবে না। উল্টে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় রয়েছে। এক গোয়েন্দা অফিসারের ব্যাখ্যা, কোনও অ্যাকাউন্ট থেকে অনলাইন ওয়ালেট এবং সেখান থেকে কোন অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকেছে, তা লিপিবদ্ধ থাকে। কিন্তু এটিএম থেকে তুলে নিলে তার আর হদিস মেলে না। এখন তো দিনে আর দু’-আড়াই হাজারের বেশি মিলছে না। ফলে জালিয়াতির টাকা রাখলে অ্যাকাউন্ট-সহ ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পুলিশকর্তাদের সন্দেহ, গত ক’দিনে ব্যাঙ্কের নেটওয়ার্কে যা সমস্যা ছিল, তাতে অনলাইনে টাকা লেনদেন করতে গিয়েও হয়তো হোঁচট খেয়েছে ওই সব জালিয়াতেরা।
গোয়েন্দাদের একাংশ অবশ্য আরও একটি কথা তুলে ধরেছেন। তাঁরা জানান, এই জালিয়াতি করে প্রচুর টাকা কামিয়েছে জামতাড়া গ্যাংয়ের সদস্যেরা। বার কয়েক তল্লাশি অভিযানে গিয়ে তাদের বৈভবের কথাও জানতে পেরেছেন তদন্তকারীরা। গোয়েন্দাদের অনেকেই মনে করছেন, জালিয়াতি করে ঘরে জমানো তা়ড়া-তাড়া নোট এ বার কী ভাবে ‘সাদা’ করবে, সেই চিন্তায় বোধ হয় ঝিমিয়ে পড়েছে জামতাড়া গ্যাং। ‘‘ব্যাঙ্কে জমা দিতে গেলে টাকার উৎস জানতে চাইবে আর জমা না দিলে ওই সব পাঁচশো-হাজারের নোট সাজিয়ে রাখা ছাড়া আর কোনও কাজে লাগবে না,’’ মন্তব্য এক গোয়েন্দাকর্তার।
তবে জামতাড়া গ্যাং নিষ্ক্রিয় হওয়া মানেই যে ব্যাঙ্ক জালিয়াতি বন্ধ হয়ে যাওয়া, তা মোটেই নয়। পুলিশেরই একাংশ বলছে, গত ক’দিনে যে হারে অনলাইনে লেনদেনের হার বেড়েছে, তাতে এমন আরও অনেক জালিয়াতি চক্র সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। শুধু জামতাড়া গ্যাংই তো একমাত্র এমন অপরাধ করে না। এখন তো নাইজেরিয়া, চিনে বসেও এ দেশের টাকা লুটে নেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের সার্ভারে যে ভাইরাস হানা হয়েছিল, তার পিছনেও চিনা হ্যাকারদের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। কলকাতারই এক আইনজীবীর টাকাই চিনের এটিএম থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল। নগদে লেনদেন না করতে পেরে ইদানীং অনেকেই অনলাইন লেনদেন করছেন। সে ক্ষেত্রে কম্পিউটর বা মোবাইলের অ্যান্টিভাইরাস, ফায়ারওয়াল যথাযথ না থাকলে জালিয়াতেরা হানা দিতেই পারে। বিপদে পড়তে পারেন আমজনতা।
এ কথা মেনে নিচ্ছেন লালবাজারের গোয়েন্দারাও। একই সঙ্গে তাঁদের অনেকের আশঙ্কা, বিদেশি হ্যাকার, জালিয়াতেরা তো রয়েইছে, নোট বদল, এটিএমের ঝক্কি কাটলেই ফের সক্রিয় হতে জামতাড়া গ্যাংও। ‘‘এ তো আর পাকাপাকি বন্দোবস্ত নয়। লাগাতার অভিযোগ থেকে ক’দিন শুধু রেহাই মিলেছে মাত্র,’’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলছেন এক গোয়েন্দা অফিসার।