ছোট্ট আরিয়ানের তখন তিন বছর। মায়ের নজরে এল ওই বয়সেই পিঠে ব্যাগ তোলার জন্য হাত ঘোরাতে গিয়ে ব্যথা হচ্ছে। শুরু হল ছোটাছুটি। জানা গেল, আরিয়ানের হৃদযন্ত্রের মাইট্রাল ভাল্ভ-এর উপরে কিছু আস্তরণ জমে মোটা হয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসা পরিভাষায় যাকে বলে ‘মাইট্রাল ভাল্ভ থিকেনড’। এর কারণ বিরল রোগ ‘মিউকোপলিস্যাকারাইডোসিস-২’ (এমপিএস-২)।
সারা দেশে এমপিএস আক্রান্ত নথিভুক্ত রোগীর সংখ্যা ২৫০। গোটা বিশ্বে সংখ্যাটা ২৫০০। এ রাজ্যে আট। যদিও এ রোগের সচেতনতায় গড়া ‘লাইসোজোমাল স্টোরেজ ডিজঅর্ডার্স সাপোর্ট সোসাইটি-র তথ্য বলছে, এ দেশে আক্রান্তের সংখ্যা ইতিমধ্যেই দু’হাজার ছাড়িয়েছে। আর তা থেকেই উঠে আসে এই অসুখ সম্পর্কে আক্রান্তের পরিবার এবং চিকিৎসকদের সচেতনতার অভাব। ভূক্তভোগী পরিবারগুলিকে একজোট করতে বিশ্বের এমপিএস কমিউনিটি গত কয়েক বছর ধরে ১৫ই মে দিনটি এ রোগের সচেতনতা দিবস হিসেবে পালন করছে।
এমপিএস কী? বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, কোষের লাইসোজোম বিভিন্ন পাচক রসের সাহায্যে খাদ্যের অন্তর্গত বর্জ্য বস্তুকে কোষের বাইরে বার করে দেয়। কোনও পাচক রসের অভাবে বা কম ক্ষরণে লাইসোজোম সে কাজ করতে পারে না। ফলে কোষে বর্জ্য জমে শরীরের বিভিন্ন অংশ ফুলে যায়। এমপিএস রোগীর ক্ষেত্রে জমে মিউকোপলিস্যাকারাইড বর্জ্য।
এমপিএস-এর লক্ষণ প্রকাশ হতে শুরু করে দুই থেকে তিন বছর বয়সী শিশুর শরীরে। চ্যাপ্টা নাক, ঠোঁট ও ত্বক মোটা হয়ে যাওয়া, ঘাড় ছোট, বেঁটে চেহারা, মাংসপেশি শক্ত হয়ে তার সঞ্চালন ক্ষমতা নষ্ট হওয়া রোগের লক্ষণ। ধীরে ধীরে যকৃৎ এবং প্লীহা বেড়ে যায়, শ্বাসযন্ত্রে সংক্রমণ ও হৃদযন্ত্রের সমস্যা হয়। জিনঘটিত এই অসুখ বাবা অথবা মা কিংবা উভয়ের মাধ্যমেই শিশুর শরীরে আসতে পারে।
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অপূর্ব ঘোষ বলেন, ‘‘অত্যন্ত ব্যয়বহুল হলেও চার ধরনের এমপিএস-এর ক্ষেত্রে চিকিৎসা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপি ও বিভিন্ন ধরনের ছোট ছোট কাজের মাধ্যমে শরীর ও স্নায়ুকে সজাগ রাখা হয়। বাকি ধরনের এমপিএসের কোনও চিকিৎসা নেই। বিনা চিকিৎসায় রোগীকে বেশি দিন বাঁচানোও সম্ভব নয়।’’
কী ভাবে এই রোগ প্রতিরোধ সম্ভব?
অপূর্ববাবুর মতে, ‘‘পরিবারে কেউ জিনঘটিত কোনও রোগে আক্রান্ত হলে বাড়তি সচেতনতা হিসেবে বিয়ের আগে জেনেটিক স্টাডি করানো উচিত। তাতে জিনে কোনও ত্রুটি থাকলে ধরা পড়বে। সে ক্ষেত্রে এমপিএস রোগাক্রান্ত শিশু জন্ম দেওয়ার সম্ভাবনা ২৫ শতাংশ। রোগ সম্পর্কে সচেতনতা, সঠিক সময়ে রোগ নির্ধারণ খুবই জরুরি। তবে এ দেশে রোগাক্রান্ত পরিবারগুলি একজোট হয়ে সংগঠন গড়ে তুলছে, এটাই
আশার কথা।’’
রোগ সম্পর্কে সচেতনতা গড়তে এবং আক্রান্ত পরিবারগুলিকে একজোট করতে এ দেশে লাইসোজোমাল স্টোরেজ ডিজঅর্ডার্স সাপোর্ট সোসাইটির প্রতিষ্ঠা ২০১০ সালে। এক হাজার সদস্যের পাঁচশো জন আক্রান্তের বাবা-মা। সর্বভারতীয় এই সংগঠনের সভাপতি মনজিৎ সিংহ বলেন, ‘‘নিকটাত্মীয়ের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কের সূত্রে এই রোগ হতে পারে। নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে মানুষকে সচেতন করা সোসাইটির কাজ। অত্যন্ত ব্যয়বহুল এই চিকিৎসার খরচ রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে দেওয়ার দাবি নিয়ে লড়ছে সোসাইটি।’’
কী ভাবে কাজ করে এই সংগঠন? যুগ্ম সম্পাদক শিবশঙ্কর চৌধুরী বলেন, ‘‘সংস্থা নিজস্ব ওয়েবসাইট এবং সোশ্যাল মি়ডিয়ায় সচেতনতার প্রচার চালাচ্ছে। সংযোগ রাখা হচ্ছে বিদেশে এই রোগ নিয়ে কাজ করা সংস্থা এবং চিকিৎসকদের সঙ্গেও। দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় আক্রান্ত পরিবারগুলিকে পরামর্শ দিয়েও পাশে থাকে সোসাইটি।’’