ফিরহাদ হাকিম।
এত দিন পুলিশের একাংশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতেন হকারেরা। তাঁদের নির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল, এক শ্রেণির পুলিশ নিজেদের ‘রোজগারের’ জন্য শহরের রাস্তার যত্রতত্র বেআইনি ভাবে হকার বসিয়ে দেয়। এ বার আর হকারেরা নন, এই কথা বলছেন কলকাতার বিদায়ী পুর প্রশাসক খোদ ফিরহাদ হাকিমই।
২০১৪ সালে ‘পথ বিক্রেতা (জীবিকা সুরক্ষা ও পথ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ) আইন’-এর পরে ২০১৮ সালে রাজ্যেও সেই নীতি তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এখনও কেন কলকাতায় তা প্রণয়ন করা গেল না, তার উত্তরে ফিরহাদ বলেন, ‘‘কোনও রাজনৈতিক দল হকার বসায় না। হকার বসায় এক শ্রেণির পুলিশ, নিজেদের রোজগারের জন্য!’’ ফিরহাদের এই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতা পুলিশের কর্তারা অবশ্য কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি হকার নীতি প্রণয়ন না করা নিয়ে পুরসভা তথা রাজ্য সরকারকে কলকাতা হাইকোর্টের ভর্ৎসনার মুখে পড়তে হয়েছে। পুরসভার আইনজীবী ইরা ঘোষ বলছেন, ‘‘আগামী চার সপ্তাহের মধ্যে পুরসভাকে হলফনামা জমা দিতে বলেছে আদালত।’’ রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা স্বীকার করেছেন, এ নিয়ে যথেষ্ট অস্বস্তিতে আছে সরকার।
ঘটনাপ্রবাহ বলছে, ‘বেশির ভাগ শহরেই হকারি পেশাকে বেআইনি বলে মনে করা হয়।’ হকারদের অন্যতম জাতীয় সংগঠন ‘ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব স্ট্রিট ভেন্ডর্স অব ইন্ডিয়া’ (এনএএসভিআই)-র একটি সমীক্ষায় এমনই লেখা হয়েছিল। সময় পাল্টেছে। কিন্তু হকারি পেশার থেকে ‘বেআইনি’ তকমার গ্লানি মোছেনি। ‘‘অথচ এটা কেউ বলেন না যে, আমরাই বেআইনি হকারদের বিরুদ্ধে সরব হই।
পুলিশে অভিযোগও দায়ের করি।’’— বলছেন হকারদের অন্যতম সংগঠন ‘হকার সংগ্রাম কমিটি’-র সভাপতি শক্তিমান ঘোষ। যেমন, গত মাসেই ধর্মতলা চত্বরের একাধিক জায়গায় ফুটপাত দখল করে বসা হকারদের বিরুদ্ধে নিউ মার্কেট থানায় অভিযোগ দায়ের করেছে কমিটি। কলকাতা ট্র্যাফিক পুলিশের এক কর্তা শুধু বলেছেন, ‘‘আমরা সব সময়েই চেষ্টা করি যাতে রাস্তার মূল অংশ দখল না হয় অথবা ফুটপাত দিয়ে পথচারীদের চলাচলে অসুবিধা না হয়।’’
অথচ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মতো হকার-নীতি প্রণয়নের জন্য স্থানীয় পুর প্রশাসন, পুলিশ, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, বাজার ও আবাসন সংগঠনের পাশাপাশি হকারদের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি ‘টাউন ভেন্ডিং কমিটি’ তৈরির কথা ছিল। সংশ্লিষ্ট কমিটিরই এলাকাভিত্তিক সমীক্ষা, হকারির শংসাপত্র প্রদান, হকিং-নন হকিং জ়োন চিহ্নিতকরণ, হকারদের পরিচয়পত্র প্রদান-সহ একাধিক কাজ করার কথা। কলকাতা পুরসভা ২০১৭ সাল নাগাদ সেই কমিটি তৈরি করলেও আইনি জটিলতায় তা বাতিল হয়ে যায়। ফলে, নীতি প্রণয়নের প্রথম ধাপ অর্থাৎ সমীক্ষার কাজটাই এখনও হয়নি!
অনেকের মতে, এ শহরে অন্য সমস্ত ক্ষেত্রের মতোই ‘দাদা’ ধরলে ফুটপাত, এমনকি এলাকাবিশেষে রাজপথের একাংশও ‘ফ্রি’ হয়ে যায়। ‘দাদারাই’ ঠিক করে দেন, কে কোথায় বসবেন বা আদৌ বসবেন কি না। এই ‘দাদারা’ কারা? তাঁরা বহু রূপে অবতীর্ণ হন শহরের বিভিন্ন এলাকায়। হকারি পেশার সঙ্গে ৩৫ বছর যুক্ত হরিসাধন সাহার কথায়, ‘‘কখনও পুলিশ, কখনও স্থানীয় নেতা, কখনও এলাকার ছেলে, যেখানে যাঁর শক্তি, সেখানে তিনি তা দেখান!’’
তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে শহরের হকার সংখ্যা প্রায় আড়াই লক্ষ। কিন্তু ১৯৯৬ সালের নভেম্বরে পুরসভার হকার উচ্ছেদ অভিযান ‘অপারেশন সানশাইন’-এর নেতৃত্বাধীন দলের অন্যতম সদস্য, প্রাক্তন পুরকর্তা স্বপন মহাপাত্র বলছেন, ‘‘বছর ২৫ আগেই কলকাতায় প্রায় দু’লক্ষ হকার ছিলেন। এখন সেই সংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচ-ছ’লক্ষ হবে।’’ সেই সংখ্যা উড়িয়ে দিচ্ছেন না হকারদের একাংশও। ‘আদি’ ও ‘নব্য’ হকারদের দ্বন্দ্বের পিছনেও পুলিশ-প্রশাসনের গাফিলতিকে দায়ী করেছেন তাঁরা।
শুধু নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে ‘দাদা সৌজন্যে ফুটপাত ফ্রি’ সংস্কৃতির অবসান হবে— এমনটাই চাইছেন শহরের সংখ্যাগরিষ্ঠ হকারেরা।