চোর ধরতে এসে পুলিশ ধরে ফেলেছি

সহযাত্রীদের মনের সেই চাপা সন্দেহ বয়ে নিয়েই তবু নির্বিঘ্নে চলছিল যাত্রা। কিন্তু বাস হাওড়া ব্রিজের কাছে পৌঁছতেই হঠাৎ তা গড়াল আতঙ্কে। সেই আতঙ্ক ঘিরেই শহরের এই বেসরকারি বাসে বৃহস্পতিবার ছড়াল বলিউডি চাঞ্চল্য।

Advertisement

দীক্ষা ভুঁইয়া

শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০১:৪৩
Share:

প্রতীকী ছবি।

পাশাপাশি, হাতে হাত। সেই দু’জোড়া হাত আবার সযত্নে একই গামছায় জড়ানো!

Advertisement

এক জনের পরনে পাজামা আর টি-শার্ট। পাশের জনের প্যান্ট আর হাফ শার্ট। গায়ের রং শ্যামলা। এক জনের বয়স ৩৫ থেকে ৪০। অন্য
জন ৪৫ ছুঁইছুঁই। চেহারাও বেশ ভাল। সেই সল্টলেক থেকে টানা দু’জনে বাসে পাশাপাশি বসে। বিনা বাক্য বিনিময়ে। একে অপরের দিকে তাকাচ্ছেও না বিশেষ।

সব মিলিয়ে এক কথায় যাকে বলে সন্দেহজনক।

Advertisement

সহযাত্রীদের মনের সেই চাপা সন্দেহ বয়ে নিয়েই তবু নির্বিঘ্নে চলছিল যাত্রা। কিন্তু বাস হাওড়া ব্রিজের কাছে পৌঁছতেই হঠাৎ তা গড়াল আতঙ্কে। সেই আতঙ্ক ঘিরেই শহরের এই বেসরকারি বাসে বৃহস্পতিবার ছড়াল বলিউডি চাঞ্চল্য।

পুলিশ সূত্রে খবর, এ দিন বেশ কিছু ক্ষণ ধরেই কেউ কেউ নজর করছিলেন সন্দেহজনক ওই দুই সহযাত্রীকে। অনেকেই খেয়াল করছিলেন, এক জন একটু এ দিক-ও দিক হলেই অপর জনের হাতে টান পড়ছে। দু’জনেই তবু নিজের মতো চুপচাপ গম্ভীর হয়ে বসে। হাওড়া ব্রিজের কাছাকাছি পৌঁছতেই সন্দেহজনক দুই সহযাত্রীর হাতে বাঁধা গামছার একটু অংশ সরে যায়। পিছন থেকে উঁকি দিয়ে বেরিয়ে পড়ে চকচকে বস্তু। তা চোখে পড়তেই পাশে বসা যাত্রীদের হাল তো আত্মারাম খাঁচা ছাড়ার জোগাড়!

কারণ তত ক্ষণে অনেকেই চিনে ফেলেছেন গামছার আড়ালের ‘হ্যান্ডকাফ’। শুরু হয় চোখাচোখি, ফিসফিস। তবে কি এরা আসামি? জেল থেকে পালাচ্ছে নিশ্চই!

সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বিশেষ দেরি করেননি পাশের আসনে থাকা যাত্রীরা। আতঙ্কটা হইচইয়ে পরিণত হওয়ার আগেই এক যাত্রী চুপচাপ পকেট থেকে বার করে ফেলেন মোবাইল ফোন। ডায়াল করে ফেলেন ১০০ নম্বরে। পুলিশ ছাড়া এমন সঙ্কটে আর কে-ই বা সহায় হতে পারে!

ভারী কণ্ঠে এক্কেবারে চাপা গলায় হয় খবর আদানপ্রদান। ফোন তুলতেই পুলিশ শুনতে পায়, ‘‘দাদা, অমুক রুটের বাসে বসে রয়েছি। সামনের আসনে সন্দেহজনক দু’জনে বসে রয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে কোনও জেল থেকে পালাচ্ছে। এখনই চলে আসুন। হাওড়া ব্রিজের কাছাকাছি রয়েছে আমাদের বাস।’’

বিকেল ৪টের সময়ে কন্ট্রোল রুমে এই ফোন পেয়ে আর দেরি করেননি পুলিশকর্মীরাও। কন্ট্রোল রুম থেকে সোজা ফোন যায় সে সময়ে বড়বাজারের কাছে থাকা কর্তব্যরত পুলিশ সার্জেন্টের কাছে। ‘বন্দি পালানোর’ খবর পেয়ে তিনিও সটান পৌঁছে যান ব্রিজের উপরে। সেখানেই আটকান সল্টলেক-হাওড়া রুটের ওই বাস। উঠে দেখেন, পাকা খবরই এসেছে যে তাঁর কাছে। হাতকড়া তো আর যার-তার হাতে থাকে না।

কিন্তু বাসে উঠে সন্দেহভাজন দু’জনকে নামাতে যেতেই বিপত্তি! প্যান্ট-শার্ট পরা যুবক কিছুতেই নামতে রাজি নন। হিন্দিতে সমানে বলে চলেছেন, জয়পুরের গোয়েন্দা বিভাগের লোক তিনি। রাজস্থান থেকে এসেছেন পাশের ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে। একই পরিচয় জানিয়ে যাত্রীদের মধ্যে থেকে উঠে এলেন আর এক জনও। কিন্তু তাঁদের ভাষা বোঝা দায়। ফলে বেশ কিছু ক্ষণ ধরে চলতে থাকে বাক-বিতণ্ডা।

তা ছাড়া এক জন গোয়েন্দা হঠাৎ হাতকড়া পরে বসবেনই বা কেন বাসে? তাই কলকাতার সার্জেন্টের সাফ হুকুম, ‘‘চলুন থানায়। কাগজপত্র দেখান। তার পরে দেখা যাবে কোথায় যাবেন।’’

কিন্তু আর একটু পরেই হাওড়া থেকে ট্রেন ছাড়ার কথা। থানা ঘুরে যেতে গেলে ট্রেন ধরা হবে না। এ দিকে সার্জেন্টও নাছোড়। শেষে মানতেই হল স্থানীয় পুলিশের কথা। হ্যান্ডকাফ পরা দু’জনের সঙ্গে তৃতীয় ব্যক্তিও হাজির হলেন উত্তর বন্দর থানায়। কিন্তু পুলিশকর্মী কি আর ‘সাদা’ পোশাকে থানায় যেতে পারেন? তাই ব্যাগ খুলে বেরোল ইউনিফর্মও। সব কাগজপত্র খতিয়ে দেখল কলকাতার থানা। যখন ছাড়া মিলল, তখন সাড়ে ৪টে বেজে গিয়েছে। ট্রেন ধরার জন্য হাতে সময় খুবই কম। এ বার পুলিশের সাহায্য নিয়েই পাঁচ মিনিটে হাওড়া পৌঁছে রাজধানী এক্সপ্রেস ধরেন তাঁরা।

পরে কলকাতা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, রাজস্থানের জয়পুর থেকে আসা ওই দুই পুলিশকর্মী গোয়েন্দা বিভাগের লোক। তাঁরা সল্টলেকের বাসিন্দা তুলসীপ্রসাদ বার্মা নামে এই ব্যক্তিকে গয়না চুরির অভিযোগে
৩৭৯ ধারায় গ্রেফতার করতে এসেছিলেন। পাছে বন্দি হাতছা়ড়া হয়ে যায়, তাই নিজের হাতের সঙ্গে তুলসীপ্রসাদের হ্যান্ডকাফটা বেঁধে রেখেছিলেন ওই পুলিশকর্মী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement