সুইৎজারল্যান্ড থেকে কখনও নিজে এসে, কখনও প্রতিনিধি পাঠিয়ে গত চোদ্দ বছর ধরে সোনা মুথুলিঙ্গম পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে খুঁজে বেড়িয়েছেন তাঁর জন্মদাত্রী মা-কে। সে খোঁজ এখনও বন্ধ হয়নি।
সোনা না পেলেও জন্মদাত্রী-কে খুঁজে পেয়েছেন জুলি বৈশাখি গেনগ্লার। ইউরোপের ছোট্ট দেশ লুক্সেমবার্গ থেকে কলকাতায় এসে বড়দিনে তিনি দেখা করে গিয়েছেন তাঁর সঙ্গে। তবে এই প্রথম নয়, সাত বছর আগে এক বার এই ভাবে লুকিয়ে মা-কে দেখে গিয়েছিলেন জুলি। তার পর ফের হারিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর মা। নুতন করে মা-র খোঁজ শুরু করতে হয়েছে জুলিকে।
সোনা আর জুলির মধ্যে মিল এক জায়গাতেই। দু’জনের মা-ই তাঁদের কয়েক মাসের শিশুকন্যাদের তুলে দিয়েছিলেন দু’টি বেসরকারি হোমে। সেখান থেকেই এই দুই কন্যাকে দত্তক নিয়েছিলেন তাঁদের বিদেশি বাবা-মা। বড় হয়ে দু’জনেই জানতে পারেন তাঁদের জন্মদাত্রীর কথা। এক বার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে, তাঁকে ছুঁয়ে দেখতে দু’জনেই ফিরে এসেথিলেন বাংলায়। কিন্তু, সোনার মায়ের হদিশ আজও কেউ দিতে পারেননি। দু’বছর আগে আনন্দবাজারে সোনার খবর পড়ে শহরতলির এক বৃদ্ধা নিজেকে সোনার মা বলে পরিচয় দিয়ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ফোনে কথাও হয়েছিল সোনা-র। কিছু সংশয় ছিল বলেই দু’জনের ডিএনএ মেলানোর ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু ডিএনএ মেলেনি। তাই আজও খোঁজ শেষ হয়নি সোনার।
সাত বছর আগে এক বার দেখা পাওয়ার পর ফের হারিয়ে যাওয়া মা- কে দেখতে জুলি এসেছিলেন কলকাতায়। বড়দিনে এ শহরের এক হোটেলে আপ্লুত জুলির সামনে থেকে এক ঝাপটায় উড়ে যেতে দেখা গেল ভাষা ও দেশের যাবতীয় গন্ডি। তাঁর সামনে বসে জন্মদাত্রী। সেই মা, যিনি যৌবনে এক সম্পর্কে জড়িয়ে পৃথিবীতে এনেছিলেন শিশুকে। সমাজের ভয়ে সেই মেয়েকে পালন করার সাধ্য ছিল না তাঁর। মহাভারতের কুন্তির মতোই তিনি হোম কর্তৃপক্ষের কাছে এসে বিসর্জন দিয়েছিলেন তাঁর ‘মেয়ে-কর্ণ’-কে। পরে বিয়ে করে তিনি সংসার শুরু করেন। কিন্তু মাত্র ১৫ বছর বয়সে জন্ম দেওয়া সেই শিশুকন্যাটিকে দেখার টানকে উপেক্ষা করতে পারেননি তিনি। জুলির বয়স এখন ২১। লুক্সেমবার্গের স্থানীয় ভাষা ছাড়া সড়গড় জার্মান ভাষায়। তাঁর সঙ্গে জার্মান বয়ফ্রেন্ড। উল্টোদিকে বসে অতি সাধারণ পরিবারের, অতি সাধারণ এক মা। তাঁর ভাষা বাংলা। জুলি-কে তাঁর জন্মদাত্রীর কাছে পৌঁছে দিয়েছেন, সেই ‘এগেইনস্ট চাইল্ড ট্রাফিকিং’ সংস্থার অঞ্জলি পওয়ার দোভাষীর সাহায্য নিয়ে কথা চালাচালি করছিলেন।
জুলির হাতে হাত রেখে মায়ের প্রশ্ন ছিল, ‘‘এই সুন্দর দেখতে ছেলেটা কি তোমাকে বিয়ে করবে? আমি প্রথম জীবনে যে ভুল করেছি, তুমি যেন তা করো না!’’ কথা শুনে হেসে খুন ইউরোপের মেয়ে। যে দেশে তাঁরা বাস করেন, সেখানে বিয়ে না করেও নির্বিঘ্নে একসঙ্গে থাকতে পরেন সাবালক পুরুষ-মহিলা। হাসতে হাসতেই জুলি জবাব দেন, ‘‘চিন্তা করো না! পরের বার তোমার সঙ্গে যখন দেখা করতে আসব, তখন বিয়ে করেই আসব। আর বিয়ের আগে আমাদের সন্তানও হবে না।’’ আচমকা শুকিয়ে যায় মায়ের মুখ। স্বামীকে, পরিবারের কাউকে না জানিয়ে লুকিয়ে দেখা করতে এসেছেন মেয়ের সঙ্গে। জানেন না, তাঁরা এই কথা জানতে পারলে কী হবে! তবু তিনি চান, মেয়ে আবার আসুক তাঁরা কাছে। সামান্য কয়েক মুহূর্তের দেখায় সাধ মেটেনি তাঁর।
জন্মদাত্রীর টানে এ দেশে ফিরে আসা বিদেশির তালিকায় অবশ্য জুলি বা সোনার কোনও ব্যতিক্রম নন। জার্মানিতে থাকেন ‘এগেইনস্ট চাইল্ড ট্রাফিকিং’ সংস্থার প্রধান অরুণ ডোল। তিনি নিজেও দত্তক সন্তান। পুণের এক হোম থেকে তাঁকে দত্তক নিয়ে যান জার্মানির ডোল পরিবার। পরে ফিরে এসে জন্মদাত্রীর খোঁজ পান অরুণ। টেলিফোনে তিনি বলেন, ‘‘সপ্তাহে গড়ে ২-৩টি অনুরোধ আসেই। বিদেশে বড় হয়ে ওঠা দত্তক সন্তানরা এক বার ফিরে যেতে চান জন্মদাত্রীর কাছে। তবে তার মানে এই নয় যে তাঁরা দত্তক বাবা-মাকে ছেড়ে যাচ্ছেন।’’ অরুণের বক্তব্য, ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে বাবার পরিচয় তাঁরা জানতে পারেন না। জন্মদাত্রী যখন জানতে পারেন, তাঁরে সন্তান বিদেশ থেকে এসে তাঁর সঙ্গে এক বার দেখা করতে চান, তখন প্রায় ১০০ শতাংশ ক্ষেত্রেই লুকিয়ে-চুরিয়ে হলেও একবার তাঁরা দেখা করতে চান সন্তানের সঙ্গে।
ঠিক যেমন সবাইকে লুকিয়ে এসেছিলেন জুলির মা।