আড়াল: যন্ত্রণায় ক্লান্ত এক রোগী।
চিকিৎসা বন্ধের কারণে বিপন্নতা ছিলই। সেই সঙ্গে ‘দূরত্ব-বিধি’ অস্তিত্বের সঙ্কট তৈরি করছে ক্যানসার রোগীদের অনেকের মধ্যেই। কারণ, এই দূরত্ব-বিধি তো শুধু সামাজিক নয়, পরিবারের ক্ষেত্রেও তা পালন করতে বলছেন বিশেষজ্ঞেরা। তা অবসাদগ্রস্ত ক্যানসার রোগীদের বিপন্নতা বহু গুণে বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে জানাচ্ছেন ক্যানসার চিকিৎসক এবং মনোবিদেরা।
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, এমনও ঘটনা ঘটেছে যেখানে কোনও কোনও পরিবারের সদস্যদের বদ্ধমূল ধারণা, ক্যানসার রোগীদের প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হওয়ায় তাঁদের মাধ্যমেই কোনও ভাবে কোভিড-১৯ সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে। যার ফলে সেই রোগী চূড়ান্ত অবহেলার শিকার হচ্ছেন। আবার উল্টো ঘটনাও ঘটছে। রোগীদের যাতে ক্ষতি না হয়, তাই তাঁদের সঙ্গে অনেক পরিবারের সদস্যই দূরত্ব রেখে কথা বলছেন। এর ফলও উল্টো হচ্ছে। রোগীদের অনেকেই পরিবার থেকে নিজেদের বিচ্যুত মনে করছেন।
মানসিক চিকিৎসার উৎকর্ষকেন্দ্র ‘ইনস্টিটিউট অব সাইকায়াট্রি’-র অধিকর্তা প্রদীপ সাহা বলছেন, ‘‘কোভিড-১৯ পরিস্থিতি আমাদের চিরাচরিত আচরণের বাহ্যিক প্রকাশে পরিবর্তন এনেছে। এমনিতেই ক্যানসার রোগীরা অবসাদে ভোগেন। সেখানে পরিবারেও পারস্পরিক দূরত্বের কারণে ওই রোগীরা মনে করছেন, তাঁরা অবহেলিত। এই ধারণা দৃঢ় হলে এমনকি আত্মহত্যার মতো বিপর্যয়েরও আশঙ্কা তৈরি হয়।’’ জোধপুরের ‘অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সেস’-এর ডিরেক্টর, ক্যানসার শল্য চিকিৎসক সঞ্জীব মিশ্র বলেন, ‘‘দূরত্ব-বিধি মানার জন্য সরকারের তরফে স্পষ্ট নির্দেশিকা রয়েছে। বাড়িতে ক্যানসার আক্রান্ত থাকলে মাস্ক এবং গ্লাভস পরে তাঁর কাছে যাওয়াই যায়। তাঁদের আলাদা করাটা একবারেই ঠিক নয়।’’
আরও পড়ুন: শুনানি মুলতুবি হাইকোর্ট ও আলিপুরে
তবু আলাদা করা হচ্ছে। কারণ, এত প্রচারের পরেও সমাজের বড় অংশের মধ্যেই ক্যানসার নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। যেমন, ক্যানসার ছোঁয়াচে রোগ! যে কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকেও (হু) এর বিরুদ্ধে লাগাতার প্রচার চালাতে হচ্ছে। ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘বহু বাড়িতেই ক্যানসার রোগীদের থালা-বাটি আলাদা করে দেওয়া হয়। আর কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে কোনও কোনও ক্ষেত্রে ক্যানসার রোগীর ঘরের বাইরেই খাবার রেখে দিচ্ছে পরিবার!’’
আগ্রার ‘ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড হসপিটাল’-এর সিনিয়র ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট রাকেশ কুমার বলছেন, ‘‘অনেক পরিবারের ধারণা, ক্যানসার রোগীদের প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হওয়ার কারণে তাঁদের মাধ্যমেই কোভিড-১৯ ছড়াতে পারে। এ সব ক্ষেত্রে দূরত্ব-বিধিকে অজুহাত হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে।’’ ক্যানসার শল্য চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘সাধারণ সময়েই ক্যানসার রোগীরা বহু ক্ষেত্রে সামাজিক ভাবে ব্রাত্য থাকেন। নানা ভাবে তাঁদের মানসিক হেনস্থার শিকার হতে হয়। এই পরিস্থিতিতে তাঁদের প্রতি সেই মনোভাবই আরও প্রকট হয়ে উঠেছে।’’
এখান থেকে বেরোনোর একটাই উপায় বলে জানাচ্ছেন ক্যানসার চিকিৎসক ও মনোবিদেরা। তা হল ক্যানসার রোগীদের সঙ্গে দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় কাটানো। তাঁদের সঙ্গে গল্প করা। লুধিয়ানার দয়ানন্দ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের প্রধান বি পি মিশ্র বলছেন, ‘‘এটা মনে রাখতে হবে, মানসিক অবসাদের কারণে ক্যানসার রোগীরা বিপন্নতায় ভোগেন। তখন যুক্তি খুব বেশি কাজ করে না। এর মধ্যেই যতটা সম্ভব দূরত্ব-বিধির কারণ তাঁদের বোঝাতে হবে।’’ চেন্নাইয়ের ‘ক্যানসার ইনস্টিটিউট (ডব্লুআইএ)’-এর ক্যানসার শল্য চিকিৎসক অরবিন্দ কৃষ্ণমূর্তির মতে, ‘‘ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে প্রধান দু’টি চ্যালেঞ্জ। প্রথমটি হল তাঁদের মানসিক বিপন্নতা। সামাজিক-পারিবারিক দূরত্ব তাঁদের উপরে অসম্ভব নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তার দ্রুত সমাধান দরকার। এ ছাড়া ক্যানসার চিকিৎসার বিষয়টি তো রয়েছেই।’’
পরপর দু’দিনে মৃত্যু হয়েছে অভিনেতা ইরফান খান, ঋষি কপূরের। দু’জনেই ছিলেন ক্যানসারে আক্রান্ত। দূরত্ব-বিধি ও এই খবরের প্রভাব যৌথ ভাবে ক্যানসার রোগীদের বিপন্নতা আরও বাড়িয়ে দেবে বলেই আশঙ্কা চিকিৎসকদের। হু-র তথ্য বলছে, সারা বিশ্বে প্রতি ছ’টি মৃত্যুর মধ্যে একটির কারণ হল ক্যানসার।
তার সঙ্গে কোভিড-১৯ সতর্কতায় দূরত্ব-বিধিজনিত অবসাদ যেন অন্য বিপর্যয় না ডেকে আনে, সেটাই চাইছেন সকলে।
আরও পড়ুন: পথেই অটোয় প্রসব
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)