ভুলভুলাইয়া গলিতে ইতিহাসের সৌধ

হেঁয়ালি শোনাতে পারে কথাটা। কিন্তু ঘিঞ্জি সর্পিল গলি আর তার শরীর জুড়ে কেজো জাগতিকতার মাঝে এমন ধবধবে গির্জার চুড়ো জেগে থাকাটা স্বাভাবিক বলা যাবে না।

Advertisement

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০১৮ ০২:২৭
Share:

ঐতিহাসিক: গলির আকাশে উঁকি দিচ্ছে চূড়া। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।

বড়বাজার যদি দার্জিলিং হয়, তবে এখানেই তার ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’!

Advertisement

হেঁয়ালি শোনাতে পারে কথাটা। কিন্তু ঘিঞ্জি সর্পিল গলি আর তার শরীর জুড়ে কেজো জাগতিকতার মাঝে এমন ধবধবে গির্জার চুড়ো জেগে থাকাটা স্বাভাবিক বলা যাবে না।

পায়ে পায়ে ডাইনে-বাঁয়ে ঠোক্কর! খাতাপত্তর, রং, ফিনাইল, গালা, তালা, বেলুন, রঙিন কাগজ, ময়ূরপুচ্ছ থেকে পাখি-মারা গুলতির পসরা! আর চোখ তুলে তাকালেই অনাবিল বিস্ময়। এমন হতেই পারে, এই গির্জার খোঁজে গুগল নেভিগেশন চালু রেখে তার কোলের কাছে ঘেঁষটেও সেটা পাচ্ছেন না আপনি। গলির আকাশে চাইতেই ‘ইউরেকা’! দোকানের ছাউনি, ইলেকট্রিক তারের জটের ওপারে রাজপুত্রের মতো সে দাঁড়িয়ে। পাকদণ্ডী বেয়ে ঘুরতে থাকা পথিককে যেমন নজরবন্দি রাখে তুষার-মোড়া শৃঙ্গ, বড়বাজারের এই গলিতে হাজারও আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে তিন শতকের প্রবীণ আর্মানি গির্জা।

Advertisement

ভাল নাম ‘আর্মেনিয়ান হোলি চার্চ অব নাজারেথ’। ১৭০৭ নাগাদ এখানে কাঠের গির্জা গড়ে উঠেছিল। ১৭২৪-এ আজকের এই সৌধের হয়ে-ওঠা। কলকাতার প্রাচীনতম খ্রিস্টান উপাসনালয় এটাই। রবীন্দ্রনাথের সহজ পাঠ সাক্ষী, এই গির্জার ঘড়ির ঢংঢং বহু দূরে ভেসে আসত। এখনও তার চুড়োর গায়ে ঘুরছে ঘড়ির কাঁটা। পাহাড়ি বাঁকে কুয়াশার মতোই বড়বাজারের গলির ব্যস্ত মুটে, মালবাহী ভ্যানরিকশা ঢুকে হঠাৎ আড়াল করে দিতে পারে এই সৌধ। একদা ‘প্রাচ্যের লন্ডন’ কলকাতার শৌর্য, নান্দনিক যাপনের স্মারক হয়ে সে জেগে আছে।

খুব কাছে এসেও অনেকেই গির্জার ফটক খুঁজতে হিমশিম খাবেন। অপরূপ মাঘেন ডেভিড সিনাগগ ও পর্তুগিজ গির্জাকে দু’পাশে রেখে ব্রেবোর্ন রোড ধরে হাওড়া সেতুর অ্যাপ্রোচ রোডের দিকে এগোতে থাকুন। ডানে শহর-কাঁপানো বিধ্বংসী আগুনের স্মৃতিবাহী নন্দরাম মার্কেট। তার উল্টো দিকের চিলতে গলির নাম আর্মেনিয়ান স্ট্রিট। শুক্রবার বিকেলে এ গলির মুখেই ভিড় সরিয়ে পাদ্রিসাহেবের গাড়ি ঢোকাতে তটস্থ ছিলেন গির্জার নিরাপত্তারক্ষী। রোববারের মাস্‌ ছাড়া আর্মানি গির্জায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ৬ জানুয়ারির তারিখটা।

অনেকেই জানেন না, এই দিনটাই আর্মেনীয়দের ‘ক্রিসমাস’। আর্মেনিয়ান অ্যাপস্টলিক বা অর্থোডক্স গির্জার মতে, ২৫ ডিসেম্বর দিনটা আদতে পেগান গন্ধমাখা। ওই দিনটায় সূর্য উপাসনা করত রোমানরা। পরে যা জিশুর জন্মদিন হয়ে ওঠে। ৬ জানুয়ারি এমনিতে খ্রিস্টানদের ‘ফিস্ট অব এপিফ্যানি’র দিন। সে-দিনই ঈশ্বরপুত্র বলে মান্যতা পান জিশু। আজ, শনিবার ‘ক্রিসমাস’-এর সকালে জিশুর ব্যাপটিজম-এর উৎসবে মেতে উঠবে বড়বাজারের আর্মানি গির্জা।

গ্র্যান্ড হোটেলের রূপকার অ্যারাটুন স্টিফেন বা শিল্পপতি আপকার আলেকজান্ডারের মতো প্রভাবশালী আর্মেনীয়রা জড়িয়ে এ শহরের ইতিহাসের সঙ্গে। বড়বাজারের গির্জার গায়েও সেই সম্ভ্রান্ত ছাপ। আর্মেনিয়ান স্ট্রিট, ওল্ড চায়না বাজার স্ট্রিটের ভুলভুলাইয়া ত্রিভুজের মতো ঢেকে রেখেছে এই গির্জা-চত্বর। ঢুকলেই উঠোনে আর্মেনীয়দের সাবেক সমাধিক্ষেত্র। একটি কবরের স্মৃতিফলকের তারিখ, ১১ জুলাই ১৬৩০।

ক্রিসমাসের সকালে এই উঠোন পার হয়েই গির্জায় ঢুকবেন শহরের ত্রিকালদর্শী বৃদ্ধা ৯২ বছরের সোনিয়া জন। ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের আর্মেনিয়ান কলেজের সূত্রে কলকাতা এখনও ইরাক-ইরান-আর্মেনিয়ার শ’খানেক পড়ুয়ার শিক্ষানিকেতন ও হস্টেল। বেশিরভাগই উজ্জ্বল ভবিষ্যতের খোঁজে আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ামুখী হবে। গুটিকয়েক কলকাতায় থিতু। ক্ষয়িষ্ণু কিন্তু আভিজাত্যে রাশভারী কিছু নরনারী এখনও শিকড়ের টানে এই বড়বাজারে আসেন। অচিন ভাষায় উপাসনার মন্দ্রস্বর ধাক্কা খায় সাবেক দেওয়ালে।

তিন শতকের বহতা নদী তখন মূর্ত হয়ে উঠেছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement