রাজ্যে ভোট পরিচালনার দায়িত্বে বিজেপির পাঁচ নেতা। বাঁ দিক থেকে সুনীল দেওধর, দুষ্যন্ত গৌতম, বিনোদ তাওড়ে, হরিশ দ্বিবেদী ও বিনোদ সোনকর। ফাইল চিত্র।
সুনীল দেওধর, দুষ্যন্ত গৌতম, বিনোদ তাওড়ে, হরিশ দ্বিবেদী এবং বিনোদ সোনকর। বাংলার বাইরে থেকে এই পাঁচ নেতাকে এনে গঙ্গাপাড়ের নীলবাড়ি দখলে নামছে বিজেপি। এঁরা সকলেই নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের ‘আস্থাভাজন’। অমিতের নির্দেশেই বাংলায় ভোটের রণনীতি তৈরি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এই পাঁচ নেতার উপর। পশ্চিমবঙ্গকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করে একেকটি এলাকার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে পাঁচ নেতার প্রত্যেককে। ঘটনাচক্রে, এঁরা প্রত্যেকেই অবাঙালি। অতীতে রাজনীতির কাজও করেছেন বাংলার বাইরে অন্যান্য রাজ্যে। সেই প্রেক্ষিতেই তাঁদের নিয়ে তৃণমূল তীব্র কটাক্ষ করেছে— ‘‘বাংলার লড়াইয়ে বাঙালির উপর আস্থা রাখতে পারছে না বিজেপি!’’ বুধবারই তৃণমূলের মুখপাত্র তথা সাংসদ সুখেন্দুশেখর রায় ওই পাঁচ নেতাকে ‘বহিরাগত’ বলে অভিহিত করেছেন। বুধবারই ওই পাঁচ নেতার মধ্যে চারজন নিজেদের জন্য নির্দিষ্ট এলাকায় বৈঠক শুরু করে দিয়েছেন।
বস্তুত, আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোটের আগে রাজ্য বিজেপি-র দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ এবং কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি মুকুল রায়ের দুই বিবদমান গোষ্ঠীর কাজকর্মে ক্ষুণ্ণ কেন্দ্রীয় নেতারা আগেই হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। সম্প্রতি দিল্লিতে ডেকে দুই শিবিরকেই সতর্ক করা হয়েছে। কিন্তু তার পরেও কোনও ঝুঁকি না নিয়ে মোদী-শাহ জুটি এই পাঁচ নেতাকে বিধানসভা ভোট সামলানোর দায়িত্ব দিয়েছেন। ঘটনাচক্রে, এঁরা প্রত্যেকেই অবাঙালি। এই রাজ্যের স্থানীয় বাসিন্দাও নয়। সেই সূত্রেই তৃণমূলের মুখপাত্র সুখেন্দু অভিযোগ করেছেন, ‘‘বহিরাগতদের দিয়ে রাজ্যে অশান্তির চেষ্টা করছে বিজেপি।’’ যার পাল্টা আবার বঙ্গ বিজেপি-র পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয় বলেছেন, ‘‘আমরা কি চিন থেকে এসেছি নাকি?’’
কিন্তু কারা এই পাঁচজন যাঁদের নিয়ে যুযুধান দু’পক্ষে এই চাপানউতোর? এর আগে কোন কোন রাজ্যে কাজ করেছেন তাঁরা? বাংলার বিধানসভা ভোটে এঁদের কাকে কোন এলাকার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে? হদিস দেওয়ার চেষ্টা করল আনন্দবাজার ডিজিটাল।
প্রথম: সুনীল দেওধর
এক সময়ের সঙ্ঘের প্রচারক সুনীল দেওয়ধর এখন বিজেপি-র সর্বভারতীয় সম্পাদক। বিজেপি-তে আসার পরে গুজরাতের দাহোড় জেলার দায়িত্বে ছিলেন। তখন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ২০১৩ সালে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে ছিলেন দক্ষিণ দিল্লির দায়িত্বে। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে মোদীর কেন্দ্র বারাণসীর দায়িত্ব সামলান সুনীল। অতীতে দীর্ঘসময় উত্তর-পূর্বের রাজ্য মেঘালয়ে সঙ্ঘ প্রচারকের দায়িত্ব সামলানো সুনীলকে ত্রিপুরার পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব দেওয়া হয় ২০১৮ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে। মুম্বইয়ের সুনীল আগরতলার পাকাপাকি বাসিন্দা হয়ে যান। ত্রিপুরায় বিজেপি-র সাফল্যের পর এখন তিনি অন্ধ্রপ্রদেশের পর্যবেক্ষক। গত লোকসভা ভোটে কলকাতার দুই আসনের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। সংসার পাতেননি। বিজেপি-তে বলা হয়, সংগঠনই সংসার সুনীলের। সাধারণ কর্মীদের সঙ্গে মিশে যাওয়ার ক্ষেত্রে সুনীলের বড় অস্ত্র স্থানীয় ভাষা। ত্রিপুরায় থাকার সময়ে ‘ককবরক’ ভাষা আয়ত্ত করে ফেলা সুনীল অন্ধ্রের দায়িত্ব পাওয়ার আগে থেকেই শুরু করেছেন তেলুগু ভাষাশিক্ষা। ভাল বাংলাও জানেন। বিধানসভা ভোটে মেদিনীপুর জোনের দায়িত্বে। এই জোনে রয়েছে দুই মেদিনীপুর ছাড়াও ঝাড়গ্রাম, হাওড়া ও হুগলি জেলার আসনগুলি।
দ্বিতীয়: দুষ্যন্ত গৌতম
বিজেপি-র অন্যতম সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দুষ্যন্ত গৌতম হরিয়ানা থেকে রাজ্যসভার সাংসদ। দিল্লিতেই জন্ম। দিল্লিতেই বড় হওয়া। তবে অনেক রাজ্যে বিজেপি-র দায়িত্ব সামলেছেন। বর্তমানে ছত্তীসগঢ়ের পর্যবেক্ষক দুষ্যন্ত মধ্যপ্রদেশে বিজেপি-র সাফল্যে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন। দীর্ঘসময় বিজেপি-র তফসিলি মোর্চার দায়িত্বে ছিলেন। ২০১৯ সালে বিজেপি গোটা দেশে যে ‘সদস্যতা অভিযান’ চালিয়েছিল, তার গুরুভার ন্যস্ত ছিল দুষ্যন্তর উপরে। বাংলার ভোটে দিল্লির দুষ্যন্ত সামলাবেন কলকাতা জোন। এই জোনে কলকাতা ছাড়া রয়েছে সম্পূর্ণ দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও উত্তর ২৪ পরগনার একাংশ।
তৃতীয়: বিনোদ তাওড়ে
মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী বিনোদ এখন বিজেপি-র সর্বভারতীয় সম্পাদক। একই সঙ্গে তিনি হরিয়ানার পর্যবেক্ষকের দায়িত্বে। লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির জাতীয় কো-অর্ডিনেশন কমিটির সদস্য ছিলেন। দু’দফায় মহারাষ্ট্র বিজেপি-র সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। প্রথমবার ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৯। দ্বিতীয়বার ২০০২ থেকে ২০১১। সামলেছেন সর্বভারতীয় দায়িত্বও। ২০১৪ সালে মহারাষ্ট্রের বোরিভলি আসন থেকে জিতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পান প্রথম দেবেন্দ্র ফঢণবীস মন্ত্রিসভায়। স্কুলশিক্ষা, উচ্চশিক্ষা, প্রযুক্তি শিক্ষা, মেডিক্যাল শিক্ষা দফতরের পাশাপাশি ক্রীড়া, সংস্কৃতি, মরাঠি ভাষা দফতরও ছিল তাঁর হাতে। মহারাষ্ট্র বিধানসভায় এক সময় বিরোধী দলনেতাও ছিলেন বিনোদ। নীলবাড়ি দখলের লড়াইয়ে বিনোদের দায়িত্বে নবদ্বীপ জোন। এই জোনে রয়েছে মুর্শিদাবাদ, নদিয়া এবং উত্তর ২৪ পরগনার একাংশ।
আরও পড়ুন: নামেই মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ, সময় এলেই পদত্যাগ করতে বাধ্য করবে বিজেপি: শিবসেনা
চতুর্থ: হরিশ দ্বিবেদী
উত্তরপ্রদেশের হরিশ বর্তমানে বিজেপি-র সর্বভারতীয় সম্পাদক। ২০১৪ এবং ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে পর পর দু’বার জিতেছেন উত্তরপ্রদেশের বস্তি আসন থেকে। তবে ধাক্কা খেয়েছিলেন ২০১২ সালে। সে বার বস্তি সদর বিধানসভা আসনে হরিশ পরাজিত হন বহুজন সমাজ পার্টির প্রার্থী জিতেন্দ্র কুমারের কাছে। দীর্ঘসময় উত্তরপ্রদেশ বিজেপি-র যুবমোর্চার দায়িত্ব সামলেছেন। ২০১৭ সালে যোগী আদিত্যনাথ সরকার গঠনে রাজ্যের সংগঠন সামলানোয় হরিশের বড় ভূমিকা ছিল বলেই মনে করা হয়। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময়েই অমিত শাহর নজরে পড়েন হরিশ। সেই সময়ে নিজের কেন্দ্র ছাড়াও তিনি বেশ কয়েকটি আসনের দায়িত্বে ছিলেন। পরে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনেও তাঁকে বড় দায়িত্ব দেন শাহ। বাংলায় উত্তরবঙ্গ জোনের দায়িত্বে হরিশ। এই জোনে রয়েছে উত্তরবঙ্গের সব ক’টি জেলা।
আরও পড়ুন: অন্য দলে যান বা নতুন দল গড়ুন, সিব্বলকে হুঁশিয়ারি অধীরের
পঞ্চম: বিনোদ সোনকর
সদ্য ত্রিপুরার পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পেয়েছেন বিনোদ। ২০১৪ এবং ২০১৯ সালে পর পর দু'বার লোকসভা নির্বাচনে জয়ী বিনোদের জন্ম থেকে রাজনীতি সবই উত্তরপ্রদেশে। ইলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র দু’বারই জিতেছেন কৌসম্বি লোকসভা কেন্দ্র থেকে। দীর্ঘসময় উত্তরপ্রদেশ বিজেপি-র সহ-সভাপতি থেকেছেন। পরে বিজেপি-র তফসিলি মোর্চার সর্বভারতীয় সভাপতি হন। উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা ভোটে বিপুল সাফল্য নিয়ে যোগী সরকার গঠন এবং গত দু’টি লোকসভা নির্বাচনে সে রাজ্যে ভাল ফলের পিছনে বিনোদের পরিশ্রম ছিল বলে দলের শীর্ষনেতৃত্ব মনে করেন। নিজের জয় নিশ্চিত করার পাশাপাশি রাজ্যের নির্বাচনী প্রচারেও বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন। বাংলার বিধানসভা নির্বাচনে বিনোদের দায়িত্বে রাঢ়বঙ্গ জোন। এই জোনে রয়েছে দুই বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও বীরভূম জেলা।