চোখ-ঢাকা: বুথে বসে এক পুলিশকর্মী। নিজস্ব চিত্র
দুপুর ১টা নাগাদ কয়েকশো মানুষ দুদ্দাড় ঢুকে পড়ল উলুবেড়িয়ার কালীনগর পূর্ব প্রাথমিক স্কুলে। তিনটি ব্যালট বক্স বগলদাবা করে হাঁটা লাগাল কয়েকজন। তারপর বক্সগুলি ঠাঁই পেল পুকুরের জলে। দেখলেন কনস্টেবল।
বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন? হাত নেড়ে ওই পুলিশ কর্মী জানালেন, ‘‘মাথা খারাপ! কয়েকশো মানুষ। আমি একা কী করব!’’
ত্রিস্তর নির্বাচনের জন্য তৈরি করা হয়েছিল ত্রিস্তর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। গাল ভরা নাম, পরিকল্পনাও ঠাস বুনটের— অন্তত তেমনটাই দাবি করেছিল রাজ্য প্রশাসন। সোমবার সেই নিরাপত্তার বহর দেখে বিরোধীরা যেমন দুষল পুলিশকে। শাসকও তেমন আঙুল তুলল পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার দিকে।
পঞ্চায়েত নির্বাচনের জন্য বুথ স্তরে একজন সশস্ত্র কনস্টেবল এবং একজন সিভিক ভলান্টিয়ার বহাল করা হয়েছিল। দ্বিতীয় স্তরে ১২ টি বুথ নিয়ে তৈরি এক একটি সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন একজন সাব ইন্সপেক্টর এবং দু’জন সিভিক ভলান্টিয়ার। তৃতীয় স্তরে ছিল কুইক রেসপন্স টিম। এতে একজন ইন্সপেক্টরের দায়িত্বে রাজ্য এবং ভিন রাজ্যের সশস্ত্র বাহিনীর লোকজনকে মোতায়েন করা হয়েছিল। প্রয়োজন মতো উত্তেজনা প্রবণ এলাকাগুলিতে পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল তাদের।
কিন্তু সারাদিন দুই জেলায় এমন ছবি দেখা গেল যে, শেষ পর্যন্ত হাওড়া গ্রামীণ জেলা পুলিশের কর্তারা স্বীকার করলেন, সীমিত ক্ষমতায় তাঁরা অন্তত প্রাণহানিটুকু আটকাতে পেরেছেন! সন্তুষ্টির সেই প্রায় একই সুর বেজেছে হুগলি প্রশাসনেও। উলুবেড়িয়ার জোয়ারগড়ি পঞ্চায়েতের নয়াচক প্রাথমিক স্কুলের ২০০ মিটারের মধ্যে ‘মুড়ি খাওয়ার জন্য’ জড়ো হচ্ছিল তৃণমূলের লোকজন। সেক্টরের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাব ইনস্পেক্টর শ’খানেক লোককে তাড়িয়ে দিলেন। ইনস্পেক্টর এলাকা ছাড়তেই ফের হাজির মুড়ির ঠোঙা। জানতে পেরে কর্তব্যরত ওই অফিসারের প্রতিক্রিয়া, ‘‘কী করব, ১২টি বুথের দায়িত্ব পালন করছি। এক একটি বুথে পাঁচ মিনিটের বেশি সময় দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। হাতে কোনও লোকও তো নেই যে রেখে যাব।’’
উলুবেড়িয়ার ভেকুটালে বোমাবাজি হওয়ার সময় গ্রামে এসেছিল সশস্ত্র বাহিনী। তারা এলাকা ছাড়তেই পিছনে দৌড়তে শুরু করেন গ্রামবাসীরা। বলতে শুরু করলেন, ‘‘স্যার, কয়েকজনকে অন্তত রেখে যান। না হলে আমরা মরে যাব।’’ চলতে চলতেই গ্রামবাসীদের উদ্দেশে একজন অফিসার বলে যান, ‘‘যে যার ঘরে থাকুন। বাইরে বেরোবেন না। দেখছি কী করা যায়।’’ পরে অবশ্য ওই অফিসারের স্বীকার করেছেন, ‘‘কয়েকটা মাত্র লোক। কত জায়গায় যাবো? কাকেই বা রেখে যাবো?’’
নির্বাচন কমিশনের হাওড়া জেলা পর্যবেক্ষককে ফোন করেও পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ করেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। সংবাদমাধ্যমও অবশ্য তাঁকে ফোনে পায়নি।
হুগলির ডিএসপি (শৃঙ্খলা ও প্রশিক্ষণ) প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ওসি সুমন রায়চৌধুরীর নেতৃত্বে ৬০ জনের (সিভিক ভলান্টিয়ার-সহ) ‘স্ট্রাইকিং’ ফোর্স ছুটে বেড়িয়েছে। তবে পুলিশের অনেকেই বলেছেন, এত কম বাহিনী দিয়ে এত বড় এলাকা সামলানো অসম্ভব। বাহিনীর দুই পুলিশকর্মী গরমে অসুস্থ হয়ে পড়েন বলেও জানা গিয়েছে। বেলুন-ধামাসিন পঞ্চায়েতের মারসিট এলাকায় ফাঁকা রাস্তার গাছের তলায় বিশ্রাম করতে দেখা গিয়েছে পুলিশকর্মীদের।
পান্ডুয়ায় সিপিএম অভিযোগ করেছে, পুলিশবাহিনী ছিল অপ্রতুল। অভিযোগ, তৃণমলের হামলা, বুথ দখল, অবাধ ছাপ্পায় বাধা দেয়নি পুলিশকর্মীরা। খোঁজ মেলেনি ক্যুইক রেসপন্স টিম বা স্ট্রাইকিং ফোর্সেরও। বিজেপি নেতা অশোক দত্তের অভিযোগ, ‘‘পুলিশ তৃণমূলের ক্যাডার বাহিনী হিসেবে কাজ করেছে।’’ অথচ, সেই তৃণমূলই আবার অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে। পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার কারণেউ দুই জায়গায় তাদের কর্মীরা সিপিএমের হাতে মার খেয়েছেন বলে দাবি তৃণমূল নেতাদের। পান্ডুয়া থানার ওসিকে অপসারণের দাবি ওঠে শাসকের তরফে।
পর্যবেক্ষকেরা কোথাও সক্রিয় আবার কোথাও থেকেছেন নিষ্ক্রিয়। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের মোবাইল বন্ধ ছিল বলে অভিযোগ। তবে অনেকে সক্রিয় ছিলেন। যেমন জাঙ্গিপাড়ার পর্যবেক্ষক শুভলক্ষ্মী বন্দ্যোপাধ্যায় চরকিপাক খেয়েছেন হরিপাল, জাঙ্গিপাড়ার বুথে বুথে। সিঙ্গুরে বিজেপি-র এক কর্মীর অভিযোগ, ‘‘বিশেষ প্রয়োজনে পর্যবেক্ষককে ফোন করেছিলাম। সা়ড়া মেলেনি।’’