পেটের-টানে: স্টিয়ারিং হাতে গঙ্গাধর। নিজস্ব চিত্র।
মন ভেঙে গিয়েছে গঙ্গাধরের।
রোজগার তলানিতে ঠেকেছে। টাইমে ছোটা, যাত্রীদের মুখঝামটা, অন্য গাড়িচালকদের গালাগাল— সব সহ্য করেও আর পেটের ভাত জোগাতে পারছেন না ষাট ছুঁইছুঁই এই বাস-চালক। করোনা পরিস্থিতি এবং পরিবহণ শিল্পের দুর্দশা তাঁর মানসিক এবং আর্থিক স্থিতি তছনছ করে দিয়েছে। তাই জিটি রোড, বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে, বিমানবন্দর, বিশ্ববাংলা সরণি ধরে এতদিন যিনি বাস চালিয়ে এসেছেন, তিনি ভাবছেন, স্টিয়ারিং থেকে হাত সরিয়ে নেবেন। পুরুলিয়ায় ফিরে মাঠেঘাটে ছাগল চরাবেন।
গঙ্গাধর পরামানিকের বাড়ি পুরুলিয়ার কেন্দা থানার জামবাঁধা গ্রামে। শ্রীরামপুর বাস টার্মিনাসের কাছে একটি ভাড়াবাড়িতে ছোট ছেলেকে নিয়ে থাকেন। পুরুলিয়ার রুখু প্রান্তর ছেড়ে জোয়ান অবস্থায় এসে প্রথমে থেকে গিয়েছিলেন কলকাতায়। ভালই চলছিল। কিন্তু এখন প্রৌঢ়ত্বের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে পেট চালাতে তাঁকে যে অন্য কিছু ভাবতে হবে, এটাই মেনে নিতে পারছেন না তিনি।
খরচ বহু গুণ বেড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আকাশছোঁয়া। অথচ, উপার্জন দিন দিন কমছে। গঙ্গাধর জানান, আগে মাসে ৭-৮ হাজার টাকা বাড়িতে পাঠাতেন। এখন তত রোজগারই নেই। কিছু দিন টাকা পাঠাতেই পারেননি। স্ত্রী সুমিত্রার ভরসা রেশনের চাল।
গঙ্গাধরের কথায়, ‘‘ডাল, তেল, আনাজ, রান্নার গ্যাস— আমাদের সাধ্যের মধ্যে কোনটা আছে? আগে মাছে-ভাতেই ছিলাম। মাঝেমধ্যে মাংস হতো। এখন মাছ কিনতে সাত বার ভাবতে হয়। মাংস বলতে গেলে ছেড়েই দিয়েছি।’’
পুরুলিয়ায় যুবক গঙ্গাধরের কাজ-কারবার ছিল না। ব্রিগেডে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সভায় এসে এখানেই থেকে যান। এক পুলিশ অফিসারের বাড়িতে ফাইফরমাস খাটার কাজ মেলে। মাসে ৫০ টাকা আর খাওয়া-দাওয়া। স্বভাবগুণে ওই পুলিশ অফিসারের বিশ্বস্ত হয়ে ওঠেন। বিমানবন্দর-বাবুঘাট ৩০বি রুটে ওই অফিসারের দাদার একটি বাস চলত। তাতে খালাসির কাজে লাগেন গঙ্গাধর। এক দিন সন্ধ্যায় বাস পরিষ্কারের সময় সিটের নীচে একটি ব্যাগে কয়েক লক্ষ টাকা কুড়িয়ে পান। থানায় গিয়ে ওই টাকা জমা দেন।
ওই ঘটনার পরের দিনই তৎকালীন পরিবহণমন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী বিরাটির স্ট্যান্ডে গিয়ে গঙ্গাধরের সঙ্গে দেখা করেন। জানতে চান, তিনি কী চান? গঙ্গাধর জানিয়েছিলেন, বাসচালক হতে চান। সুভাষবাবু অন্য চালকদের গঙ্গাধরকে বাস চালানো শেখানোর দায়িত্ব দেন। খালাসি থেকে চালক হিসেবে উত্তরণ ঘটে তাঁর।
তখন থেকে বেশ চলছিল। এক সময় শ্রীরামপুর-বাগবাজার ৩ নম্বর রুটের বাস চালাতেন। ওই রুটের তখন রমরমা। উপার্জন ভালই হত। এ সবের মধ্যেই বিয়ে, গ্রামে মাটির বাড়ি ভেঙে অ্যাসবেসটসের চালের পাকা বাড়ি তৈরি— সবই হয়েছে। চার ছেলেমেয়ের মধ্যে দুই মেয়ের বিয়েও দিয়েছেন।
কিন্তু কয়েক বছর ধরেই বাসে যাত্রী কমছিল। টোটোর বাড়বাড়ন্ত বাসের কফিনে কার্যত শেষ পেরেক পুঁতে দেয়। কাজ হারান গঙ্গাধর। তার পরে তিনি স্কুলবাস চালানো শুরু করেন। সেই কাজ কেড়ে নেয় করোনা। কারণ, সংক্রমণ রুখতে স্কুল বন্ধ। শেষে, শ্রীরামপুর-সেক্টর ফাইভ ২৮৫ নম্বর বাসে চালকের কাজ জোটে। তবে, আয় কমে তিন ভাগেরও নীচে। করোনা আবহে দীর্ঘদিন বাস চলাচল বন্ধ থাকায় সেই রোজগারেও পরিস্থিতির থাবা পড়ে। এখন বাস চললেও যাত্রী নেই। তার উপরে জ্বালানির দাম বৃদ্ধিতে খরচ বেড়েছে। কিন্তু ভাড়া বাড়েনি। সব মিলিয়ে বাসশিল্পে নাভিশ্বাস।
গঙ্গাধর জানান, টিকিট বিক্রির কমিশন হল রোজগার। অর্থাৎ, যে দিন যেমন যাত্রী, সে দিন তেমন আয়। কোনও দিন ২৫০, কোনও দিন ৩০০ টাকা। কদাচিৎ আরও ৫০ টাকা আসে। ৩ নম্বর বাসে দৈনিক আয় হতো হাজার টাকারও বেশি। গঙ্গাধরের খেদ, রোজগার কমেছে। বছর খানেক ধরে ছোট ছেলে কৃষ্ণপদ বাসে কন্ডাক্টরের কাজ করছেন। রোজগার তাঁর থেকেও কম।
গঙ্গাধর ও তাঁর ছেলে যে ভাড়াবাড়িতে থাকেন, তার ভাড়া মাসে ৩ হাজার টাকা। সঙ্গে বিদ্যুৎ বিল আরও কয়েকশো টাকা। কাজে থাকলে দুপুরে হোটেলে খাওয়ার খরচ। সব মিলিয়ে বাপ-ছেলে পেরে উঠছেন না।
চশমার কাচে বাষ্প জমে। ঘোলাটে লাগে গঙ্গাধরের চোখ।