Ramadan

রোজার মাসে লক্ষ্মীলাভ সঞ্জয়, দীপকদের

মিষ্টির দোকানের কর্মী দুই ভাই সঞ্জয়, ধনঞ্জয় বা অর্জুন পান্ডে, আদতে উৎকলের জাজপুরের ছেলে দীপক বেহেরার জন্যও রমজান মানে কিছু বাড়তি টাকাপয়সার মুখ।

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০২৫ ০৯:৪৯
Share:
বিকিকিনি: ইফতারের আগে তেলেভাজার পসরা নিয়ে সঞ্জয় পুরকায়েত। মোমিনপুর রোডে।

বিকিকিনি: ইফতারের আগে তেলেভাজার পসরা নিয়ে সঞ্জয় পুরকায়েত। মোমিনপুর রোডে। —নিজস্ব চিত্র।

ইফতারের ডাকের আজান দিতে আধঘণ্টাটাক বাকি। তড়িঘড়ি মোমিনপুরে মা-বাবার বাড়ির পাড়া থেকে বেহালা ফিরবেন সামিনা আলি। জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ পলিটেকনিক কলেজের সামনে মোটরবাইকে বসে সঞ্জয় পুরকায়েতকে দ্রুত কিছু ডিমের চপ, চিকেন উইঙ্গস, বেগুনি, পকোড়া গুছিয়ে দিতে বললেন হেলমেটধারিণী।

সামিনা গোখেল স্কুলের ক্যারাটে শিক্ষিকা। তাঁর সঙ্গে মোটরবাইকে সওয়ার, সদ্য তরুণ পুত্র মহম্মদ রেহান আলি। আগামী সপ্তাহে ইদ মিটতে না মিটতেই ছেলে জর্জিয়ায় ডাক্তারি পড়তে যাবেন। শেষ পর্বের কেনাকাটি চলছে। সেই সব সেরে কিছু ভাজাভুজি কিনে বাড়িমুখো হলেন মা, ছেলে।

ইফতার শুরুর এই প্রাক্-মুহূর্তে ওই তল্লাটের মহম্মদ হাকিম, গুলাম মহম্মদদের মতো সঞ্জয় পুরকায়েত, ধনঞ্জয় পুরকায়েত বা দীপক বেহেরাদেরও কার্যত মরার সময় নেই। পলিটেকনিক কলেজের সামনে মোমিনপুরের গলির দু’ধারে রমজান মাসে জমজমাট ফুড স্ট্রিট। নাক বরাবর এগিয়ে বাঁয়ে ষোলো আনা মসজিদকে ফেলে সটান ফ্যান্সি মার্কেটের দিকে গিয়েছে। জ়াকারিয়া স্ট্রিট, কলুটোলার মতো স্বাদ-সুরভিতে বহু বিশ্রুত না-হলেও এমন ছোট-বড় স্বাদ-সরণি শহর জুড়েই। আর তাতে বেমালুম ঘুচে যায় ক্রেতা-বিক্রেতার ধর্ম পরিচয়ের ফারাক। ২০২৫-এর ভারতে মহাকুম্ভের আগে ভিন্‌ধর্মীদের উপস্থিতি নিয়ে সশব্দে সতর্ক করা হয়। কিংবা শ্রাবণের কাঁওয়ার যাত্রায় পথের দু’ধারে বিক্রেতাদের ধর্ম-পরিচয় চিহ্নিত করতে তৎপর হয় উত্তরপ্রদেশের পুলিশ। ঠিক তখনই উৎসবের কলকাতায় অন্য এক ভারতবর্ষের স্বর।

ঠাকুরপুকুরের দিলীপ রায় রমজান মাসটায় এই মোমিনপুর এলাকাতেই বিকেল থেকে ফলের ঠেলা নিয়ে বসেন। বারুইপুর থেকে পেয়ারা, জামরুল এনেছেন। যার যেমন চাহিদা, কাউকে পেয়ারা কেটে বিটনুন মাখিয়েও দিচ্ছেন। দিলীপের কথায়, ‘‘রোজার মাসটা আমাদের লক্ষ্মী। অন্য সময়ের তুলনায় দু’-চারশো টাকা বেশি হাতে আসে!’’ স্থানীয় বাসিন্দা রাজেন্দ্র কুমার বছরের অন্য সময়ে গাড়ি সারাইয়ের কাজ করেন। রোজার মাসে তিনিও ফল বিক্রেতা।

মিষ্টির দোকানের কর্মী দুই ভাই সঞ্জয়, ধনঞ্জয় বা অর্জুন পান্ডে, আদতে উৎকলের জাজপুরের ছেলে দীপক বেহেরার জন্যও রমজান মানে কিছু বাড়তি টাকাপয়সার মুখ।
মিষ্টির দোকানের বাইরে পেঁয়াজি, ফুলুরি থেকে চিকেন ললিপপ, পকোড়া, প্যান্ত্রাস— নানা কিসিমের মুরগি কড়ায় ভাজছেন তাঁরা। গরম-গরম টেবিলে উপুড় করতেই নিমেষে উড়ে যাচ্ছে ইফতারের আগে। দীপক বললেন, ‘‘আমাদের নিরামিষ তেলেভাজার দোকানে রোজার মাসটাই ডিম-চিকেনের
আইটেম ভাজি।’’

ডায়মন্ড হারবারের সঞ্জয় এখন বৌ, বাচ্চা নিয়ে মোমিনপুরের বাসিন্দা। বলছিলেন, ‘‘এখন এটাই আমার নিজের পাড়া হয়ে গিয়েছে!’’ আজকাল দেশের নানা প্রান্তে
বিশেষ উৎসবে ভিন্‌ধর্মীদের মোলাকাতে সংঘাতের প্ররোচনার অভিযোগ ওঠে। এই ইফতারি বাজারে দাড়ি-টুপির সঙ্গে মন্দিরের প্রসাদী টিপ, হাতে বিপত্তারিণীর সুতোর নিশ্চিন্ত সহাবস্থান। কর্পোরেট কর্মী, স্থানীয় তরুণ আফজ়ল খান ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’-এর ফাঁকে ইফতারের ভাজাভুজি কিনতে বেরিয়েছেন। হেসে বললেন, ‘‘এটা সাজানো সম্প্রীতি নয়। এখানে মেলামেশাটাই স্বাভাবিক রীতি।’’

এ শহরে নানা ধর্ম, সংস্কৃতির মেলবন্ধনের কাজে সক্রিয় ‘নো ইয়োর নেবর’ বলে একটি মঞ্চের আহ্বায়ক সাবির আহমেদ বলছিলেন, ‘‘মুশকিল হল, কলকাতার কয়েকটি পাঁচমিশেলি পাড়া ছাড়া হিন্দু, মুসলিমের এতটা গা ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকার পরিসর কম। তাই
অনেকের জীবনেই রোজা-ইফতার বা ভিন্‌ধর্মী সংস্কৃতির ছোঁয়াচ অধরা থেকে যায়।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন

এটি একটি প্রিমিয়াম খবর…

  • প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর

  • সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ

  • সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে

সাবস্ক্রাইব করুন