জলপাইগুড়ি ভাগ হয়ে গিয়েছে। বর্ধমানও হব-হব করছে।
এরই মধ্যে মুর্শিদাবাদ জেলা ভাগ করার সওয়াল উস্কে দিলেন জেলার এক মাত্র মন্ত্রী জাকির হোসেন। তাঁর মতে, “উন্নয়নের স্বার্থেই পিছিয়ে পড়া জেলা মুর্শিদাবাদের বিভাজন জরুরি।”
নিজের বিধানসভা কেন্দ্র জঙ্গিপুরে মহকুমাশাসকের দফতর লাগোয়া একটি সার্কিট হাউস নির্মাণের সূচনা করতে এসেছিলেন জাকির। রাজ্য পূর্ত দফতর সেটি নির্মাণ করছে। সেখানেই প্রসঙ্গটি ওঠে। জাকির বলেন, ‘‘জেলা ভাগের জন্য আমি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে সুপারিশ করব।’’
বিষয়টি নিয়ে এর আগেও যে নাড়াচাড়া হয়নি তা নয়। জঙ্গিপুরের পূর্বতন কংগ্রেস বিধায়ক তথা রাজ্যের পরিষদীয় দলনেতা মহম্মদ সোহরাব জানান, প্রথম বার ক্ষমতায় আসার পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক বার তাঁকে ও বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রকে বৈঠকে ডাকেন। সব দলের নেতারাই সেখানে ছিলেন।
নবান্ন সূত্রের খবর, জলপাইগুড়ি এবং মুর্শিদাবাদ জেলা ভাগ নিয়ে ওই বৈঠকে বিস্তারিত কথা হয়েছিল। সোহরাবের দাবি, ‘‘জলপাইগুড়ি ভেঙে আলিপুরদুয়ার ও মুর্শিদাবাদ ভেঙে উত্তর মুর্শিদাবাদ আলাদা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। জলপাইগু়ড়ি ভাগ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মুর্শিদাবাদের ব্যাপারে আর সাড়াশব্দ নেই।”
এখন জেলাসদর বহরমপুর। জেলা ভাগ হলে উত্তরে নতুন জেলার সদর হবে রঘুনাথগঞ্জ। প্রশাসনিক কর্তাদের একাংশের মতে, রঘুনাথগঞ্জকে কেন্দ্র করে নতুন জেলা তৈরির সব পরিকাঠামোই প্রস্তুত। নতুন পরিবহণ দফতরও চালু হয়ে গিয়েছে সেখানে। জাকির বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আমার প্রথম সুপারিশই হবে জেলা ভাগ করার। তাতে এই পিছিয়ে পড়া জেলায় উন্নয়নের কাজে গতি আসবে। এ বার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি যা সিদ্ধান্ত নেবেন, তা-ই হবে।’’
জেলার কোন কোন এলাকা নিয়ে গড়া হবে নতুন জেলা? এর আগে যত বার এই আলোচনা গড়িয়েছে, মূলত জঙ্গিপুর মহকুমার সঙ্গে লালগোলা, নবগ্রাম, ভগবানগোলা ১ ও ২ ব্লক মিলিয়ে নতুন জেলা গড়ার কথা ভাবা হয়েছে। দক্ষিণের বাকি এলাকা থেকে যাবে পুরনো জেলাতেই। জাকির অবশ্য এ নিয়ে ভেঙে বলতে চাননি কিছু। তিনি বলেন, “আগে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব দিই। তাঁর মতামত পাই। তার পরে প্রশাসনিক পর্যায়ে কমিটি গড়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হবে। কিছুটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।’’
৬৬ শতাংশ সংখ্যালঘু অধ্যুষিত মুর্শিদাবাদ জেলা দেশের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম পিছিয়ে পড়া জেলা হিসেবে চিহ্নিত। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় জঙ্গিপুরে সাংসদ থাকাকালীনই জেলা ভাগের দাবি উঠেছিল। কিন্তু না বাম, না তৃণমূল সরকার, কেউই সদর্থক পদক্ষেপ করেননি। জাকিরের প্রস্তাব সমর্থন করছেন ফরাক্কার কংগ্রেস বিধায়ক মইনুল হক এবং সমশেরগঞ্জের তৃণমূল বিধায়ক আমিরুল ইসলামও। বহরমপুর থেকে এই দুই বিধানসভা এলাকার দূরত্ব একশো কিলোমিটারেরও বেশি। আমিরুল বলেন, “এই বিভাজন হলে সবচেয়ে উপকৃত হবেন সমশেরগঞ্জ ও ফরাক্কার মানুষ। সমশেরগঞ্জের শেষ প্রান্ত ঝাড়খণ্ড লাগোয়া ভাসাই পাইকর এবং দোগাছি। জেলা সদরে গিয়ে সে দিনই কাজ সেরে ফেরা সেখানকার মানুষের পক্ষে অসম্ভব।”
মইনুলের বক্তব্য, “জলপাইগুড়ি যখন ভাগ হয়, তখনই বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রীকে মুর্শিদাবাদ ভাগ করার কথা বলেছিলাম। বহু টাকা খরচের কথা বলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। ফরাক্কা থেকে সদর বহরমপুরে যেতে আসতে ৬ ঘণ্টা লাগে। কে না জানে, জেলা ছোট হলে প্রশাসন গতি পায়!”
সমশেরগঞ্জের প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক তোয়াব আলি জানান, বাম সরকার অশোক মিত্রের নেতৃত্বে একটি প্রশাসনিক কমিশন গড়েছিল। তাদের সুপারিশ ছিল ২৪ পরগনা, বর্ধমান ও মুর্শিদাবাদকে ভৌগোলিক কারণেই ভাগ করার। তাঁর মতে, ‘‘বড় সংখ্যালঘু জেলা হিসেবে মুর্শিদাবাদের কথা আগে বিবেচনা করা উচিত।’’
জাকিরের মতে, ‘‘পরিকাঠামোগত ভাবে জঙ্গিপুরকে কেন্দ্র করে জেলা ভাগ হলে এলাকার মানুষ উপকৃত হবেন।” রঘুনাথগঞ্জের কংগ্রেস বিধায়ক আখরুজ্জামানও বলেন, “গত বিধানসভায় মুর্শিদাবাদ ভাগের দাবি তুলেছিল কংগ্রেস। তা বিবেচিত হয়নি। এখন সে দাবি তুলেছেন মন্ত্রী জাকির হোসেন। তাঁর এই প্রস্তাব সর্বতো ভাবে সমর্থনের যোগ্য।”৫৩২৪ বর্গ কিলোমিটার ছড়ানো মুর্শিদাবাদ জেলায় জনসংখ্যা ৮০ লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে। জনঘনত্বে রয়েছে রাজ্যের মধ্যে ৫ম। বিভাজিত জেলাগুলির মধ্যে শুধু উত্তর ২৪ পরগনা ছাড়া সব ক’টিই এর অর্ধেক অথবা অনেক পিছনে।
তৃণমূলের রঘুনাথগঞ্জ ১ ব্লক সভাপতি মুক্তিপ্রসাদ ধর জানান, জঙ্গিপুর মহকুমার ৭টি ব্লক ছাড়াও লালগোলা, ভগবানগোলার ২টি ব্লক ও নবগ্রাম নিয়ে জনসংখ্যা দাঁড়াবে ৩৫ লক্ষের কাছাকাছি। যোগাযোগ সহজতর হয় এমন এলাকাগুলিকে নিয়ে নতুন জেলা গড়া যেতেই পারে। তাঁর বক্তব্য, “আমাদের জেলা সভাপতি মান্নান হোসেন আগেই জেলা ভাগের ব্যাপারে সম্মতি জানিয়েছেন। জাকির হোসেন মন্ত্রী হিসেবে স্থানীয় মানুষের মনের কথাই বলেছেন।”
এর পরে... তাঁর ইচ্ছে।