অতি তুচ্ছ কয়েকটি কৃমির ছোবলে মাসে ৮-১০ কেজি দুধ কম পাওয়া যায়। গরুর স্বাস্থ্যও ভাঙতে থাকে। বংশ পরম্পরায় গাভী পুষে এলেও এই জরুরি তথ্যটি জানা ছিল না বহরমপুর শহর লাগোয়া রঘুনাথতলা, হরিদাসমাটি, কৃষ্ণমাটি-সহ বেশ কয়েকটি গ্রামের গো-পালক রমেন ঘোষ, নিত্যানন্দ ঘোষ এবং বীরু ঘোষদের। এ বারে হাতে-কলমে অতি জরুরি সেই অজানা তথ্যটি প্রমাণ করে তাঁদের তাক লাগিয়ে দিয়েছে বহরমপুর শহরের কৃষ্ণনাথ কলেজিয়েট স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ৫ পড়ুয়া সম্প্রীত সরকার, শেখ হাসান, শুভঙ্কর রায়, শতরূপ সরকার এবং দেবাঞ্জন গুছাইত। এই সুবাদে ‘চিল্ড্রেনস সায়েন্স কংগ্রেস’ আয়োজিত রাজ্যস্তরের ‘বিজ্ঞান মডেল’ প্রতিযোগিতায় সেরার শিরোপা জিতে নিয়েছে ওই পড়ুয়ারা।
কেন্দ্র সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ আয়োজিত ২৭ ডিসেম্বর থেকে ৫ দিনের সর্বভারতীয় মডেল প্রতিযোগিতায় যোগ দেওয়ার জন্যও মনোনীত হয়েছে খুদেদের এই মডেলটি। দলনেতা হিসাবে অষ্টম শ্রেণির দেবাঞ্জন গুছাইত তাদের মডেল নিয়ে চলতি মাসের শেষের দিকে পাড়ি দিতে চলেছে চণ্ডীগড়ে। পাঁচ খুদে পড়ুয়াকে নিয়ে গড়া দলটির মেন্টর-শিক্ষক দীপঙ্কর রায় জানান, সরকারি নিয়ম মেনে মডেল নিয়ে শুধু দলপতিই চণ্ডীগড় যাবে ঠিকই, কিন্তু প্রকল্পটি আসলে ৫ পড়ুয়ার মিলিত চেষ্টার ফসল। জীবন বিজ্ঞানের শিক্ষক দীপঙ্করবাবু জানান, চণ্ডীগড়ের প্রদর্শনীতে প্রকল্পটির উন্নততর উপস্থাপনার জন্য কলকাতার নিতিকা ডন বস্কো স্কুলে শুক্রবার থেকে রবিবার পর্যন্ত ৩ দিনের কর্মশালায় দেবাঞ্জনকে প্রশিক্ষণ দেবেন যাদবপুর ও কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা।
কিন্তু এমন একটি প্রকল্পের কথা খুদেদের মাথায় এল কী করে? দেবাঞ্জন জানায়, ‘‘গোয়ালারা মাঝে মাঝেই বলেন, ‘এত খইল-গুড় খেতে দিই, সবুজ ঘাস-গহমা খেতে দিই তবুও কেন দুধ কমছে বুঝতে পারছি না!’ স্যারকে তার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন হাতে কলমে প্রমাণ করতে।’’
কৃষ্ণনাথ কলেজিয়েট স্কুল থেকে আধ কিলোমিটার দূরে ‘পলি ক্লিনিক’ নামের পশু হাসপাতাল। এর পর সেখানে গিয়ে খুদেরা পশু চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে। জেনে নেয় দুধের উৎপাদন কমার নানা কারণ। আর তার মধ্যে অন্যতম ছিল কৃমির উপদ্রব। সঙ্গে সঙ্গে খুদেদের মনে ধরে গেল কারণটি। প্রকল্পের জন্য খুঁজে পেতে বহরমপুর শহর লাগোয়া রঘুনাথতলা, হরিদাসমাটি, কৃষ্ণমাটি- সহ কয়েকটি গ্রামের ১০০টি গাভী নির্বাচন করা হল।
দেবাঞ্জন জানায়, গত জুন মাস থেকে অগস্ট পর্যন্ত ৫০টিকে গাভীকে কৃমিনাশক ট্যাবলেট খাওয়ানো হয়। বাকি ৫০টি গাভীকে সেই ট্যাবলেট খাওয়ানো হয় না। তারপর তারা ওই ১০০টি গাভীর দৈনিক দুধ উৎপাদনের হিসার নেয়। তাতে দেখা যায়, কৃমিনাশক ট্যাবলেট খাওয়ানো গাভীগুলির দুধের উৎপাদন বাকি গাভীগুলির তুলনায় মাসে ৮ থেকে ১০ কেজি বেশি।
দীপঙ্করবাবু জানান, বর্ষায় শামুক-গুগলি ইত্যাদির মধ্যে কৃমি থাকে। তাই প্রকল্পের জন্য বর্ষাকালকেই বাছা হয়েছিল। তিনি জানান, একটি কৃমিনাশক ট্যাবলেটের দাম মাত্র ৪-৫ টাকা। সরকারি পশু হাসপাতালে এই ট্যাবলেট বিনামূল্যেও পাওয়া যায়। মাসে এক বার কৃমিনাশক ট্যাবলেট খাওয়ালেই দুধের উৎপাদন বাড়ে। গবাদি পশুর স্বাস্থ্যও ভাল থাকে।
এ দিকে রঘুনাথতলার রমেন ঘোষ বলেন, ‘‘আমরা চোদ্দো পুরুষের গোয়ালা। অথচ এই বয়সে এসে শহরের কয়েকটা পুঁচকের কাছ থেকে গাই পোষা আর দুধের উৎপাদন বাড়ানো শিখতে হল! এক্কেবারে নাক কাটা গেল!’’