কথার মানেটাই বেবাক বদলে গিয়েছে! আগে ‘গরুর গাড়ি’ বলতে বোঝাতো, গরুতে টানা গাড়িতে সওয়ারি হবে মানুষ। এখন বোঝায়, মানুষই গাড়ি চালিয়ে গরু নিয়ে যাবে!
নেবে না-ই বা কেন? গরুর গাড়ি থেকেই তো রাশি রাশি টাকা উড়ছে! যে যেমন পারছে, কুড়িয়ে নিচ্ছে!
পান্ডুয়ার গরু-হাট ছেড়ে বোরোতেই তা হাড়ে হাড়ে মালুম হল। প্রথমে ট্রাক থামল মগরার এক ধাবায়। চালক জানালেন, এখন টাকার খেলা শুরু হবে। প্রস্তাব দিলাম, ‘‘ওস্তাদ, টাকা সব আমার হাত দিয়ে দেওয়াও না! এ-ও তো ট্রেনিং!” ছাত্রের কথা গুরুর মনে ধরল। তুরন্ত হাতে চলে এল নোটের তাড়া।
ধাবার কাছে চেকপোস্ট। ‘পান্ডুয়া রেগুলেটেড মার্কেটিং কমিটি’র নামে কাটা গেল গরু হিসেবে আড়াই হাজার টাকা। রাজ্য সরকারের লেভি। অতঃপর ‘বেসরকারি’ লেভির পালা। মোতায়েন পুলিশকর্মী নিলেন তিনশো। খানিক এগিয়ে একটা চালাঘরের সামনে মগরা থানার ‘প্রাপ্য’ মেটাতে হল এক ট্রিপ বাবদ তিন হাজার। গ্যারান্টি বালি ব্রিজের টোল পর্যন্ত মগরা, শ্রীরামপুর, ভদ্রেশ্বর, পোলবা বা ডানকুনির কোনও পুলিশ টাকা চাইবে না। বাস্তবিকই পথটুকু পেরলো হু-হু করে।
এনএইচ-টু ধরে রাত ন’টা নাগাদ বালি ব্রিজের পাশে নিবেদিতা সেতু টোল প্লাজা। লাইনে বিস্তর গরুর ট্রাক। টোল ২৩৫ টাকা। গাড়ি ‘চেক’ করার বালাই নেই। দশটায় ‘লাইন ক্লিয়ার’ হতে দক্ষিণেশ্বর-ডানলপ হয়ে সোজা বিটি রোড। জানা গেল, ট্রাকে রয়েছে রুটের প্রায় প্রতি থানার ‘মান্থলি কার্ড।’ পুলিশের দেওয়া রক্ষাকবচ। এক পাশে গরুর ছবি, সিল, তারিখ। অন্য পিঠে গাড়ি, ফুল বা মাছের ছবি। যা দেখেই বোঝা যাবে, কোন থানার কার্ড। গাড়িপিছু ‘মান্থলি’র দর এক থেকে চার হাজার। পাচার-পথে যে থানা-এলাকার রাস্তা বেশি, তার রেট তত চড়া।
রক্ষাকবচেও কি রক্ষা আছে?
বেলঘরিয়া ছেড়ে সোদপুরের দিকে চাকা গড়াতেই শুরু হল জিপ-মোটরবাইক নিয়ে পুলিশের তোলাবাজি। কাউকে একশো, কাউকে দু’শো। ওস্তাদ আবার এক কাঠি সরেস। মজা দেখানোর জন্য একশো টাকার নোট জানলা দিয়ে দেখিয়ে একটা জিপকে কিলোমিটার খানেক দৌড় করালেন। সে এক দৃশ্য! জিপের পুলিশ খিস্তিখেউড় করছে, টর্চের আলো নাচাচ্ছে, রুল উঁচিয়ে শাসাচ্ছে। ট্রাকের রাখালরা পাল্টা গালি ছুড়ছে, সঙ্গে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি। জিপ যখন ট্রাকের পথ আগলে দাঁড়াল, ভয়ে এ শর্মার বুক তো দুরুদুরু। ওরা দেখি নির্বিকার! উর্দি-পরা দুই পুলিশ নেমে এলেন। খালাসি তাঁদের হাতে টাকা ধরিয়ে শুরু করল তোড়ে গালাগাল ‘‘মান্থলি দিই, তা-ও? চশমখোরের দল!’’ এক পুলিশকর্মী হাসলেন। অন্য জন বললেন, ‘‘আমি একা নিচ্ছি? উপরতলায় দিতে হবে না?’’
সোদপুর থেকে ডাইনে ঘুরে মধ্যমগ্রাম রোড। কিছুটা এগিয়ে বাঁয়ে ঘুরে কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে। সামনে ব্যারাকপুর। ঘোলা, খড়দহ, টিটাগড় থানার আরটি ভ্যান (রেডিও ট্রান্সমিটার ভেহিক্লস) ছাড়াও পিসি পার্টি (সাদা পোশাকের পুলিশ) বেরিয়ে পড়েছে তোলা-অভিযানে। ব্যারাকপুর ছেড়ে বারাসত রোড ধরে নীলগঞ্জ। মোড়ে দাঁড়িয়ে পুলিশের গাড়ি। দাবি মিটিয়ে আমডাঙা-থানা এলাকা দিয়ে ট্রাক ঢুকে পড়ল ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কে কৃষ্ণনগর রোডে। ডাইনে ঘুরে জিরাট রোড ধরে অশোকনগর-হাবরা হয়ে উঠে পড়া গেল যশোহর রোডে। ততক্ষণে বার্তা চলে এসেছে ড্রাইভারের মোবাইলে। ‘‘আজ আংড়াইল বর্ডার দিয়ে মাল পার হবে।” ট্রাক-মালিকের সঙ্গে ফোনালাপ সেরে ঘোষণা করলেন ওস্তাদ। টাকা বিলোতে বিলোতে আমিও ক্লান্ত। খালাসিকে বললাম, এ বার তোমরাই দাও।
যশোহর রোড দিয়ে গো-যান এগিয়ে চলে। গাইঘাটার দুই সীমান্ত ঝাউডাঙা ও আংড়াইলের বন্যেবেড়ে, পিঁপলি, পুরন্ধরপুর, সাহেবডাঙা দিয়ে গরু ও-পারে যায়। গাইঘাটা থেকে ডাইনে ঘুরে সেকাটি গ্রামে ট্রাক থামল। রাত দু’টো। শুরু হল গরু নামানো।
হিসেব কষে দেখি, পান্ডুয়া থেকে সীমান্ত পর্যন্ত ১২২ কিলোমিটার রাস্তায় পঁচিশ জায়গায় পুলিশকে টাকা দিতে হয়েছে। গড়ে দু’শো করে ধরলে পাঁচ হাজার। মগরা থানার তিন হাজার মিলিয়ে মোট আট হাজার। সঙ্গে থানার ‘মান্থলি’ বাবদ মাসে মাসে এক থেকে চার হাজার। উপরন্তু কর্তাদের প্রণামী। গাড়ির ছাপ দেওয়া পুলিশ-কর্তার ‘মাসোহারা’র কার্ড দেখান ওস্তাদ। জানান, “রোজ গাড়িপিছু আড়াই হাজার নেয়। কাস্টমস নেয় সাড়ে পাঁচ। এদের ফাঁকি দিয়ে একটা গরুও পাচার করার উপায় নেই।”
ফোন করা হল ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার নীরজ সিংহকে। তিনি শুনে আকাশ থেকে পড়লেন। এ সবের বিন্দু-বিসর্গও জানেন না! হুগলির পুলিশ সুপার সুনীল চৌধুরীর দাবি, এমন কোনও অভিযোগ নেই। আর উত্তর ২৪ পরগনার এসপি তন্ময় রায়চৌধুরীর বক্তব্য, “সীমান্তবর্তী থানা আর বিএসএফকে সতর্ক করা হয়েছে। পাচার অনেকটা কমেছে।”
জানিয়ে রাখা ভাল, পরের সকালেই ব্যারাকপুর কমিশনারেট থেকে ফোনে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, গরু পাচার সংক্রান্ত কী কী তথ্য বা ছবি রয়েছে। উত্তর দিয়েছিলাম, ‘‘রাত দশটার পরে বিটি রোডে দাঁড়ালেই তথ্য, ছবি হাতে গরম পেয়ে যাবেন।” এ-ও জানিয়ে রাখি, সে দিন বিকেলে ট্রাক-মালিক ফোন করে প্রায় হাহাকার করেছিলেন ‘‘আরে করেছো কী? মিডিয়া খোঁজ-খবর করছে শুনে পুলিশ যে লাইন-ই বন্ধ করে দিল!”
হাহাকার মিলিয়ে যেতে অবশ্য সময় লাগেনি। পরের সকালেই এসেছিল ওঁর স্বস্তির ফোন ‘‘ভায়া, লাইন আবার ক্লিয়ার। তবে কিনা, রেটটা বাড়িয়ে দিল!”
পুলিশ নাকি নীলগঞ্জে গাড়ির নম্বর লিখে ট্রাকপিছু বাড়তি এক হাজার টাকা নিচ্ছে। খোঁজ-খবরের খেসারত!
(চলবে)