Banya Tudu

বক্তা মিনাক্ষী মঞ্চে না-থাকার আক্ষেপ পুষিয়ে দিলেন বন্যা, হুগলি জেলার আদিবাসী নেত্রীই রবিবার ব্রিগেডের চমক-কন্যা

নিজে ক্ষেতমজুরের কাজ করেন বছর ৫০-এর বন্যা টুডু। বাড়িতে রয়েছেন স্বামী, পুত্র এবং পুত্রবধূ। আর রয়েছে চারটি ছাগল। যে ছাগলগুলিকে নিয়ে মাঠে রোজ চরাতে যান তিনি। মাঠের কাজের ফাঁকে কেটে আনেন ঘাসও।

Advertisement

শোভন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০২৫ ২০:১১
Share:
মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায় এবং বন্যা টুডু। রবিবারের ব্রিগেড সমাবেশে।

মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায় এবং বন্যা টুডু। রবিবারের ব্রিগেড সমাবেশে। —সংগৃহীত।

তিনি যখন বক্তৃতা শেষ করে পোডিয়াম ছেড়ে ফিরে যাচ্ছেন, তখন তাঁর মাথায় স্নেহের হাত রাখলেন সিআইটিইউ রাজ্য সভাপতি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। নিজের বক্তৃতার সময়ে তাঁকে উদ্ধৃত করলেন সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। তিনি মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়? নাহ্। তিনি বন্যা টুডু। যে বন্যা রবিবার বামেদের ব্রিগেডে পুষিয়ে দিলেন মিনাক্ষীর নাম বক্তাতালিকায় না-থাকা নিয়ে বামজনতার আক্ষেপ।

Advertisement

দলের শ্রমিক, কৃষক, ক্ষেতমজুর এবং বস্তি সংগঠনের ব্যানারে রবিবার ব্রিগেড সমাবেশের ডাক দিয়েছিল সিপিএম। বক্তাদের তালিকায় সেলিম ছাড়া সেই অর্থে কোনও ‘বড় নাম’ ছিল না। গত কয়েক বছর ধরে যে যুবনেত্রী বামেদের ভিড় টানেন, সেই মিনাক্ষীর নাম কেন নেই, তা নিয়ে আক্ষেপ গোপন করেননি বাম কর্মী-সমর্থকদের একাংশ। ব্রিগেডের বক্তাতালিকা চূড়ান্ত হয়েছে অনেক দিন আগেই। কিন্তু এক পক্ষকাল আগে সিপিএমের পার্টি কংগ্রেস মিনাক্ষীকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য করার পরে অনেকেই আবার বলতে শুরু করেছিলেন, ওঁকে দিয়েও বলানো হোক। ওঁর নাম থাকলে ভিড় হবে। রবি-ব্রিগেডে ভিড় খারাপ হয়নি। এবং সেই ভিড়ের সমবেত প্রতিধ্বনি সবচেয়ে বেশি উঠল ‘নতুন’ কন্যা বন্যার বক্তৃতাতেই। তিনি হুগলির আদিবাসী নেত্রী। মিনাক্ষীও ঘনিষ্ঠ মহলে বন্যার বক্তৃতার প্রশংসা করেছেন। তৃণমূলের ‘খেলা হবে’ স্লোগানের পাল্টা বলতে গিয়ে বন্যা যখন বলছেন, ‘‘২০২৬ সালে ওদের উইকেট ফেলে দেব’’, তখন মঞ্চের অদূরে দাঁড়িয়ে করতালিও দেন যুবনেত্রী।

এর আগে সিপিএম নেত্রী দেবলীনা হেমব্রমকে বাংলা এবং সাঁওতালি ভাষার মিশেলে বক্তৃতা করতে ‌শোনা যেত। বন্যাও নিজের বক্তৃতায় দুই ভাষার মিশেল ঘটালেন। এবং শুরু করলেন নাটকীয় চমকে। পো়ডিয়ামে দাঁড়িয়েই জনতার উদ্দেশে বললেন, ‘‘কী কমরেড, ভাল আছেন তো?’’ অজুত কণ্ঠ জানান দিল, ‘হ্যাঁ’। শুনেই বন্যা বললেন, ‘‘কী করে ভাল আছেন? এখানে (রাজ্যে) চোর আর ওখানে (কেন্দ্রে) ডাকাতের সরকার চলছে। আমরা ভাল থাকতে পারি না।’’ তার পর ফের প্রশ্ন, ‘‘ভাল আছেন?’’ জনতা এ বার বলল, ‘না’। সেই রেশ ধরে বন্যা বললেন, ‘‘ক্ষেতমজুর, খেটে খাওয়া মানুষদের লড়াইয়ের কথা শহরের মানুষ জানে না। আমরা শেষ দেখে ছাড়ব। লড়াইয়ের পথ থেকে সরব না।’’ শুধু মঞ্চ থেকে বক্তৃতা করাই নয়, সভা শেষে বাকি কর্মীদের সঙ্গে মাঠ পরিষ্কার করতে হাতে ঝাঁটা নিয়েও নামলেন বন্যা।

Advertisement

ব্রিগেডের মঞ্চে বন্যা টুডু। ছবি: সিপিএমের ফেসবুক থেকে।

বামেদের উদ্দেশে যে প্রশ্ন ধেয়ে যায়, বক্তৃতায় সেই প্রশ্ন তুলে নিজেই জবাব দিলেন বন্যা। তাঁর কথায়, ‘‘সবাই বলে, ব্রিগেডে এত লোক, কিন্তু ভোটবাক্স খালি। মানুষের রুটিরুজির লড়াই আর ভোটবাক্স আলাদা।’’ তবে বামজনতার উদ্দেশে বন্যা এ-ও মনে করিয়ে দিলেন, শুধু ব্রিগেডে জমায়েত করলে হবে না। আসলে লড়াইটা বুথস্তরে। যেখানে সাংগঠনিক ফাঁক থেকে যাচ্ছে বলে ধারাবাহিক আলোচনা চলছে সিপিএমেও। সেই ফাঁক পূরণের উদ্দেশেই বন্যা বললেন, ‘‘এখান থেকে ফিরে গিয়ে অঞ্চলে, বুথে আমাদের কাজ করতে হবে। আমরা ভয় খাব (পাব) না। আমরা কেন ভয় খাব? আমরা তো চুরি করিনি। যারা চুরি করেছে, তারা আমাদের ভয় পাবে।’’

হুগলির গুড়াপের বাসিন্দা বন্যা। তিনি ক্ষেতমজুর সংগঠনের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য। সিপিএমের হুগলি জেলা কমিটিরও সদস্য তিনি। নিজেও ক্ষেতমজুরের কাজ করেন বছর ৫০-এর নেত্রী। বাড়িতে রয়েছেন স্বামী, পুত্র এবং পুত্রবধূ। আর রয়েছে চারটি ছাগল। যে ছাগলগুলিকে নিয়ে মাঠে রোজ চরাতে যান তিনি। মাঠের কাজের ফাঁকে কেটে আনেন ঘাসও। ২০০৩ সাল থেকে ২০১১ পর্যন্ত বন্যা ছিলেন গুড়াপের পঞ্চায়েত প্রধান। ২০০৬ সালে সিপিএমের সদস্যপদ পান তিনি। হুগলি সিপিএমের অনেকে বলেন, বন্যাকে আবিষ্কার করেছিলেন দলের অধ্যাপক নেতা তথা প্রাক্তন সাংসদ অধুনা প্রয়াত রূপচাঁদ পাল। কারণ, রূপচাঁদ দীর্ঘদিন ধরেই ধনেখালি এলাকায় দলের দায়িত্বে ছিলেন।

শনিবার দুপুরে আনন্দবাজার ডট কমের পক্ষ থেকে যখন ফোন করা হয়েছিল, প্রথমে কথাই শুনতে পাচ্ছিলেন না বন্যা। বলছিলেন, ‘‘আমাদের গেরামে (গ্রামে) কালীপুজো হচ্ছে তো, তাই বক্স বাজছে। কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছি না।’’ পরে অবশ্য কথা বলার জন্যই অন্যত্র সরে যান। তখন বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই বলেছিলেন, ‘‘সংগঠন বক্তা করেছে, আমি বলব। মানুষের সামনে মানুষের কথা বলব। ব্রিগেড বলে আলাদা কিছু নয়।’’ রবিবার বন্যা বললেন। এবং বন্যার কথা আলোড়িত করল বাম ব্রিগেডকে। আর কিঞ্চিৎ কলরব উঠল ক্ষেতমজুর সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক নিরাপদ সর্দারের বক্তৃতায়। যে নিরাপদ সন্দেশখালির প্রাক্তন বিধায়ক। যিনি গত বছর সন্দেশখালির ঘটনার সময়ে গ্রেফতার হয়ে বেশ কয়েক দিন জেলও খেটেছিলেন।

বেলা ৩টের সময়ে ব্রিগেড সমাবেশ ডেকেছিল বামেরা। প্রবল গরমে জমায়েত নিয়ে একটা দুশ্চিন্তা ছিল নেতৃত্বের মধ্যে। এমনকি বেলা আড়াইটের সময়ে যখন মূল মঞ্চের নীচে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছে, তখনও মাঠ ফাঁকা। প্রথম সারির এক সিপিএম নেতা পাশে দাঁড়ানো এক কৃষক নেতাকে বলে ফেললেন, ‘‘কী হবে গো? সবাই তো ছায়া খুঁজছে।’’ অবশ্য সভা শুরু হতেই ছায়ার মায়া কাটিয়ে লোক ঢুকতে শুরু করে ব্রিগেডে। বাইরে থেকে ঢুকতে থাকে সাতটি মিছিল। ফলে মাঠ ভরে গিয়েছিল। তবে সেই ভিড় এমন নয় যে কলকাতাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে।

কৃষক সভার অমল হালদার, সিটুর অনাদি সাহু, বস্তি উন্নয়ন সমিতির সুখরঞ্জন দে, সেলিমেরা বক্তৃতা করেছেন ব্রিগেডে। সেই সভা থেকে রুটি-রুজির লড়াইকে জোরদার করার বার্তা দিয়েছেন। কিন্তু বন্যার মতো কেউই জনতার কলরব আদায় করে নিতে পারেননি। যে সম্পর্কে সিপিএমের এক তরুণ নেতার বক্তব্য, ‘‘কর্মী-সমর্থকেরা পুরনোদের আর সে ভাবে গ্রহণ করছেন না। নতুন চাইছেন। তাই বন্যাদি, নিরাপদদারা আজ এত গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠলেন। মিনাক্ষীও যে কারণে ভিড় টানে।’’

সব মিলিয়ে, হুগলির চমক-কন্যাই রবিবার ব্রিগেডের পর বামজনতার মূল আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠলেন। ঘটনাচক্রে, একদা-বিরোধীনেত্রী এক কন্যার উত্থানেই ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল বামেদের ৩৪ বছরের শাসনক্ষমতা। ১৪ বছর আগে। তার পর নামতে নামতে শূন্যে পৌঁছে যাওয়া সিপিএম নতুন প্রজন্মের খোঁজে যখন মরিয়া, তখন মিনাক্ষীর মতো মুখেরাই ভরসা জাগাচ্ছেন। বন্যা হয়তো তরুণ মুখ নন, কিন্তু নতুন মুখ হয়ে ‘অগ্নিকন্যা’র মহড়া নিতে পারবেন? সিপিএম তাকিয়ে আছে ওঁদের দিকেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement