এতদিনে মাঠ প্রায় সাফ হয়ে যাওয়ার কথা। অথচ, মাঠের ধান পড়ে রয়েছে মাঠেই!
সৌজন্যে, ৫০০ এবং হাজার টাকার বাতিল নোট।
বাতিল নোটের ধাক্কায় আলু চাষের ভবিষ্যৎ নিয়ে আগেই প্রশ্ন উঠেছিল। আগামী মরসুমে বাজারে আলুর জোগান কমা এবং দামবৃদ্ধির আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল কৃষি দফতরও। এ বার সেই সারিতে এসে দাঁড়াল ধান, সব্জিও।
ধান যেহেতু প্রধান ফসল, তাই সেই সোনালি শস্যের ভবিষ্যৎ নিয়েই আশঙ্কা সবচেয়ে বড় হয়ে উঠছে। কৃষি দফতরের হিসেবে, চলতি মরসুমে গোটা রাজ্যে ৪৩ লক্ষ হেক্টর জমিতে আমন এবং এক লক্ষ হেক্টর জমিতে আউস ধান চাষ হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৬ লক্ষ হেক্টর জমির আমন ধান কাটা হয়েছে। বাকি ৩৮ লক্ষ হেক্টর জমির ধান মাঠেই পড়ে রয়েছে।
কেন?
নগদের অভাবের কারণে দিনমজুর না-মেলায় ধান কাটা যাচ্ছে না বলে রাজ্যের বহু কৃষক ইতিমধ্যেই কৃষি দফতরের কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন। বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয় উত্তর ২৪ পরগনার দেগঙ্গার রামনগরের চাষি সাত্তার মণ্ডলের কথায়। তিন বিঘা জমিতে আমন ধান ফলিয়েছেন সাত্তার। কিন্তু তাঁর ধান এখনও মাঠেই পড়ে রয়েছে। কারণ হিসেবে তিনি জানান, এক বিঘা জমির ধান কাটতে চার জন করে শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। প্রত্যেক শ্রমিককে দিনপ্রতি ২৫০ টাকা মজুরি দিতে হয়। কিন্তু দু’দিনের হিসেবেও কোনও শ্রমিক ৫০০ টাকার নোট নিতে চাইছেন না। প্রত্যেকে দিনের মজুরি ২৫০ টাকা খুচরোতেই নিতে চাইছেন। কিন্তু অত খুচরো মিলছে কই? তাই ধান কাটা বন্ধ।
বাগদার চাষি রবি সরকার এ বার ৬ বিঘা জমিতে ধান ফলিয়েছেন। আত্মীয়দের থেকে ৫০, ১০০ টাকার নোট ধার নিয়ে এই ক’দিনে তিন বিঘা জমির ধান কাটতে পেরেছেন রবিবাবু। তা সত্ত্বেও তিনি বিভ্রান্ত। তাঁর কথায়, ‘‘ফাঁকা জমিটা আলু আর সব্জি বোনার জন্য তৈরি করছি। কিন্তু বাকি জমির কী হবে বুঝতে পারছি না।’’
নোটের অভাবে রাজ্যের বহু চাষিরই যে একই অবস্থা, তা মানছে কৃষি দফতর। বহু ধান নষ্টেরও আশঙ্কা করছে তারা। রাজ্যের কৃষি উপদেষ্টা প্রদীপ মজুমদার বলেন, ‘‘যে ধান কাটা যায়নি, তার জন্য ধাপে ধাপে সব প্রক্রিয়াই পিছিয়ে পড়ছে। আলু থেকে শুরু করে বিভিন্ন রবিশস্য এবং সব্জি বোনার সময়সীমা পেরিয়ে যাচ্ছে। একটা সময় পরে সব্জি চাষ করলেও ফলন হবে না। ভবিষ্যতে সব কিছুরই দর বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’’
ধান কাটা সারা হলে মূলত সেই জমিতেই এ রাজ্যের চাষিরা আলু, সব্জি বা রবিশস্য চাষ করেন। সেই চাষের জন্য অন্যান্য বছর এই সময়ে বীজ বোনার কাজও শুরু হয়ে যায়। কিন্তু এ বার ব্যতিক্রম। সেই কাজ কার্যত শুরুই হয়নি। এমনকী, বীজ কিনতেও নাজেহাল হচ্ছেন অনেকে। মাথায় হাত পড়েছে তাঁদের।
নোট বাতিলের ক’দিন আগেই দেগঙ্গার চৌরাশি পঞ্চায়েতের মাটিকুমড়া গ্রামের মহম্মদ হাবিবুল্লা এক ট্রাক (১০৭ কুইন্ট্যাল) ওলবীজ কিনে এনেছিলেন। অন্যান্য বার এই সময়ের মধ্যে তিন ট্রাক ওলবীজ বিক্রি করে ফেলেন হাবিবুল্লা। এ বার এখনও প্রথম ট্রাকটির বীজই বিক্রি করে উঠতে পারেননি তিনি। হাবিবুল্লা বলেন, ‘‘ধান কাটতে না পেরে অনেক চাষিই ওলবীজ কিনতে আসছে না। যাঁরা আসছেন, তাঁদের হাতে ৫০০, হাজার টাকার নোট। কী করে বীজ দেব?’’
বেড়াচাঁপায় সব্জিবীজের ‘ভাণ্ডার’ রয়েছে মহম্মদ কামারুজ্জামানের। কিন্তু এ বার ভাণ্ডার ফাঁকা। বন্যা, খরার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরেও কস্মিনকালে এমন অবস্থা হয়েছে বলে মনে করতে পারলেন না কামারুজ্জামান। তাঁর কথায়, ‘‘আজ চাষিদের যে কী হাল, তা সরকার টের পাচ্ছে না। টের পাবে কয়েক মাস পরে। যখন বাজার আগুন হবে।’’
এখনও বাজারে সব্জির দাম নাগালের মধ্যেই রয়েছে। অনেক জায়গায় কমছেও। কিন্তু আমজনতার এই ‘সুখ’ কতদিন সইবে, তা নিয়ে চিন্তায় রয়েছে কৃষি মহল। জলপাইগুড়ির হলদিবাড়ি বাজারে এ মাসের প্রথম সপ্তাহে আলুর দাম ছিল কেজিপ্রতি ২০ টাকা। এখন বিকোচ্ছে ১০ টাকায়। ফুলকপি ৫০ টাকা থেকে নেমে ২০ টাকা হয়েছে। বাঁধাকপি ৪০ টাকার বদলে ২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ময়নাগুড়ির পাইকারি বাজারে মুলো কেজিপ্রতি ৩০ টাকা থেকে ১৫ টাকায় নেমেছে। বেগুন ২০-২৫ টাকা থেকে কমে হয়েছে ১০-১২ টাকা। গোটা লাউ আগে ১৫-২০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন ৭-৮ টাকার বেশি দাম পাচ্ছে না।
চাষিরাই বলছেন, এখন যে সব সব্জি বিক্রি হচ্ছে, তার চাষ হয়েছে নোট বাতিলের আগেই। কিন্তু নোট বাতিল পরবর্তী পর্যায়ে সেই চাষ কার্যত শুরু হয়নি। ফলে, দেরির কারণে পরের বার সব্জি উৎপাদন মারাত্মক মার খাবে। কৃষিপণ্যের দাম আমজনতার নাগালের বাইরেও চলে যেতে পারে। একই আশঙ্কা কৃষি দফতর আগেই করেছে।
আশঙ্কা বাড়ার আরও বড় কারণ, চাষিদের ঋণ নেওয়ার জায়গাগুলি ক্রমশ সঙ্কুচিত হওয়া। মূলত মহাজন বা সমবায় থেকে ঋণ নিয়ে বাংলার চাষিরা চাষ করেন। নোট বাতিলের জেরে গ্রামের মহাজনদের হাতেই এখন টাকা নেই। তাঁদের ঘটি-বাটি বিক্রির অবস্থা। বাকি ছিল সমবায়। কিন্তু শুধু নভেম্বর মাসেই প্রত্যন্ত গ্রামে সমবায় সমিতিগুলির মাধ্যমে রবিচাষের জন্য রাজ্য সমবায় ব্যাঙ্ক যে ৭০০ কোটি টাকা কৃষিঋণ বা দাদন দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল, নোট বদলের চাপে পড়ে তা কার্যত লাটে ওঠার জোগাড়। তার উপরে শুক্রবারই রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানিয়েছে, সমবায় ব্যাঙ্কগুলি এখন থেকে আর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে পুরনো ৫০০ এবং হাজারের নোট জমা দিতে পারবে না। ফলে, সেখানেও নগদের ভয়াবহ সমস্যা।
সব মিলিয়ে নোটের চোটে রাজ্যের কৃষকের রাতের ঘুম উবেছে।
সহ প্রতিবেদন: পার্থ চক্রবর্তী ও দীপঙ্কর ঘটক