সিপিএম অফিসে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পোড়া জিনিসপত্র। —নিজস্ব চিত্র।
একা হাতে প্রাণপণে দরজা আটকে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। দরজার ছিটকিনি ভেঙে ঘড়ে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়েছিল জনা কুড়ি যুবক। টিভি, ফ্রিজ থেকে আলমারি— সব কিছু তছনছ করে চলে গিয়েছে তারা।
মঙ্গলবার রাতের এমন অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে বুধবার সকালেও আতঙ্কে কাঁপছিলেন রূপনারায়ণপুরের বৃদ্ধা বাসন্তী সাহা। শুধু বাসন্তীদেবী নয়, রূপনারায়ণপুরের পশ্চিম রাঙামাটিয়া, হরিসাডি, কল্যাণগ্রাম, মহাবীর কলোনি এলাকার সাতটি বাড়িতে ওই রাতে এ ভাবে যথেচ্ছ ভাঙচুর চালানো হয়েছে। সিপিএমের দাবি, ওই পরিবারগুলি তাদের সমর্থক। সে কারণে বেছে-বেছে তাদের বাড়িতে হামলা চালিয়েছে তৃণমূলের লোকজন।
গোলমাল শুরু হয় মঙ্গলবার বিকেল থেকে। ধর্মঘটের সমর্থনে রূপনারায়ণপুরে মিছিল করছিল সিপিএম। সেই সময়েই পথসভার আয়োজন করে তৃণমূল। অভিযোগ, মিছিল থেকে সেই সভায় ইট-পাটকেল ছোড়া হয়। দু’পক্ষের মারপিট বেধে যায়। দফায়-দফায় সংঘর্ষ হয়। থামাতে গিয়ে মাথায় চোট পান রূপনারায়ণপুর ফাঁড়ির আইসি অমিত হালদার। সিপিএমের লোকাল কমিটি অফিসে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। দু’পক্ষের জনা দশেক জখম হন। এলাকায় পুলিশের বড় বাহিনী মোতায়েন করা হলেও অশান্তি পুরোপুরি থামানো যায়নি বলে স্থানীয় সূত্রে জানা যায়। সিপিএমের দাবি, আশপাশের এলাকা থেকে লোক এনে রাতে বেছে-বেছে তাদের কর্মী-সমর্থকদের বাড়িতে হামলা চালায় তৃণমূল।
এ দিন সকালে রূপনারায়ণপুরে গিয়ে দেখা যায়, দোকানপাট বন্ধ। কোনও যানবাহন চলছে না। সুনসান রাস্তা। প্রচুর পুলিশ ও বেশ কিছু তৃণমূল কর্মী-সমর্থকেরা রাস্তায় তেমন কেউ নেই। আগের রাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া সিপিএমের অফিসের সামনে পড়ে ছিল পোড়া আসবাবপত্র। রাতে হামলা হওয়া বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পুরুষ সদস্যেরা সকলেই বাড়িছাড়া। তছনছ করে দেওয়া হয়েছে মহাবীর কলোনির বাসিন্দা অভিজিত গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ি। তিনি তার আগেই পালিয়ে গিয়েছেন। বাড়িতে ছিলেন বৃদ্ধা মা অনিতাদেবী। তিনি বলেন, ‘‘রাত ১টা নাগাদ জনা কুড়ির একটি দল পাঁচিল টপকে ভিতরে ঢোকে। জানালার কাচ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। আমি চিৎকার করলেও ওরা আমল দেয়নি। ভয়ে সিঁটিয়ে ছিলাম।’’
সেখান থেকে খানিকটা দূরে থাকেন সিপিএম নেতা প্রলয় গুহনিয়োগী। প্রতিবেশীরা জানান, মাঝ রাতে তাঁর বাড়িতে যখন হামলা হয়, তখন তিনি ঘরে ছিলেন না। সাত বছরের ছেলেকে নিয়ে আতঙ্কে রাত কাটিয়েছেন তাঁর স্ত্রী। বুধবার কাকভোরে ঘর ছেড়েছেন তাঁরাও। স্থানীয় বাসিন্দা তথা প্রবীণ শিক্ষক অলোক ঘোষ বলেন, ‘‘রাতে যে তাণ্ডব হয়েছে তাতে আমরা কেউই নিরাপদ বলে মনে করছি না।’’ এলাকাবাসীর দাবি, আক্রমণের হাত থেকে বাদ পরেননি মহিলারাও। কল্যাণগ্রামের সিপিএম নেত্রী তৃপ্তি ভট্টাচার্যের বাড়িতে রাত ১টা নাগাদ চড়াও হয় দুষ্কৃতীরা। যথেচ্ছ ইট-পাটকেল ছোড়া হয়। তৃপ্তিদেবীর অভিযোগ, ‘‘ওরা চিৎকার করে শাসিয়েছে, ধর্মঘটের সমর্থনে রাস্তায় নামলে খুন করে ফেলবে। ভয়ে বাড়ির বাইরে বেরোইনি।’’
আসানসোলের প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ বংশগোপাল চৌধুরী অভিযোগ করেন, রাতে যে তাঁদের সমর্থকদের বাড়ি-বাড়ি হামলা হবে সে কথা তাঁরা পুলিশকে আগাম জানিয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। বংশগোপালবাবুর কথায়, ‘‘আমাদের বেশ কিছু সমর্থকের বাড়ি ভাঙচুর করেছে তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা। পুলিশ সে বিষয়ে কোনও ভূমিকা নেয়নি। উল্টে, আমাদের অনেক সমর্থককে গ্রেফতার করেছে। আমরা আন্দোলনে নামব।’’ সিপিএম সমর্থকদের বাড়িতে হামলার অভিযোগ উড়িয়ে এলাকার তৃণমূল বিধায়ক বিধান উপাধ্যায় বলেন, ‘‘এ সব মিথ্যে অভিযোগ করে আমাদের বদনাম করার চেষ্টা চলছে। কিন্তু আমরা শান্তি বজায় রেখেছি। সিপিএমের প্ররোচনাতেই গোলমাল হয়েছে।’’
আসানসোল-দুর্গাপুর কমিশনারেটের এসিপি (পশ্চিম) অসিত পাণ্ডে বলেন, ‘‘মঙ্গলবারের ঘটনায় এখনও পর্যন্ত ৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সিপিএম সমর্থকদের বাড়ি ভাঙচুর বা অফিসে আগুন লাগানো নিয়ে কেনও অভিযোগ থানায় জমা পড়েনি।’’