নিহতের (ইনসেটে) দেরিয়াপুরের বাড়িতে তদন্তকারীরা। ছবি: উদিত সিংহ।
বিশাল বাড়ির দোতলা, সিঁড়ি, নিচের বারান্দা, সদর দরজায় চাপ চাপ রক্ত। কলকাতার বড়বাজারের ত্রিপল ব্যবসায়ী সব্যসাচী মণ্ডল (৩৮) পৈতৃক বাড়ি পূর্ব বর্ধমানের রায়নার দেরিয়াপুরে শুক্রবার রাতে খুন হওয়ার পরে, গোটা দিন কাটলেও ঘটনা ঠিক কী ভাবে ঘটল, ঘটনাস্থলে উপস্থিতদের ‘ভূমিকা’ নিয়ে ধন্দ রয়েছে তদন্তকারীদের। রহস্যের জট ছাড়াতে ঘটনায় সময়ে ওই বাড়িতে উপস্থিত সব্যসাচীর তিন সঙ্গী এবং বেলুড় থেকে আসা এক কাকিমাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে পুলিশ। শনিবার সন্ধ্যায় ঘটনাস্থলে গিয়ে জেলা পুলিশ সুপার কামনাশিস সেন বলেন, “সব দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’
নিহতের বাবা দেবকুমার মণ্ডল এ দিন রায়না থানায় নিজের ছোট ভাইয়ের বিরুদ্ধে পারিবারিক বিবাদের কারণে তাঁর ছেলেকে খুন করানোর অভিযোগ করেন। তাঁর দাবি, “সুপারি কিলার দিয়ে আমার ছেলেকে খুন করা হয়েছে। এর আগেও কয়েকবার ওর উপরে হামলা হয়েছে। আমার বাড়িতেও আক্রমণ হয়েছে।’’ বহু চেষ্টা করেও দেবকুমারবাবুর ছোট ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
ঘনিষ্ঠদের সূত্রে খবর, গত ৮ অগস্ট সব্যসাচী যখন তাঁদের হাওড়ার বাড়িতে ঘুমোচ্ছিলেন তখন তাঁর ঘর লক্ষ করে পর পর দু’টি পেট্রল বোমা ছুড়ে পালিয়ে যায় এক দুষ্কৃতী। ওই ঘটনার পরেই সব্যসাচী বলেছিলেন, ‘‘পরিবারের এক জন আমাকে খুন করার চেষ্টা করছে। আমার পিছনে ভাড়াটে খুনি লাগানো হয়েছে। যে কোনও দিন খুন হয়ে যেতে পারি!’’
ঘটনাস্থলে গিয়ে এ দিন দেখা যায়, মণ্ডলবাড়ির পাঁচশো মিটারের মধ্যে কোনও বাড়ি নেই। বাড়ির ১২টি ঘরে তালা। তিনটে সিঁড়ি। পুলিশ জানিয়েছে, জন্ম থেকে হাওড়ার শিবপুরের বাসিন্দা সব্যসাচী শনিবার বেলা ১০টা নাগাদ নিজস্ব দেহরক্ষী রাজবীর সিংহ, চালক আলু সাউ, রাঁধুনি পার্থ সাঁতরাকে নিয়ে দেরিয়াপুরের উদ্দেশে বেরোন। বিকেল সাড়ে ৩টে নাগাদ তাঁরা পৌঁছন। রাত পৌনে ৯টা নাগাদ হামলা হয় সব্যসাচীর উপরে। বর্ধমান মেডিক্যালে নিয়ে গেলে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
পুলিশের দাবি, সব্যসাচীর সঙ্গে থাকা লোকজনেরা খুনের সময় কে, কোথায়, কী করছিলেন, সে সংক্রান্ত বক্তব্যে কিছু ‘অসঙ্গতি’ পেয়েছে তারা। যেমন আলু সাউ পুলিশকে জানিয়েছেন, দুষ্কৃতীরা পিঠের দিকে ধারাল অস্ত্র ধরে তাঁকে আটকে রেখেছিল। তবে তিনি ‘নানা সময় নানা কথা’ বলেছেন বলে দাবি পুলিশ সূত্রের। গাড়ির চালক, দেহরক্ষীদের দাবি, হামলা করে চার জন। তিন জনের মুখ ঢাকা ছিল। এক জনের মুখ খোলা থাকলেও তাঁকে তাঁরা চিনতে পারেননি। হামলা চালিয়ে তারা তারা সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়। কোনও গাড়ি বা মোটরবাইকের শব্দ পাওয়া যায়নি। কিন্তু দেরিয়াপুরের মতো প্রত্যন্ত এলাকায় গাড়ি বা মোটরবাইক ছাড়া, এ ধরনের হামলা করার ঝুঁকি আততায়ীরা কেন নেবে তা ভাবাচ্ছে পুলিশকে। বিশদ তদন্তের জন্যে ফরেন্সিক দলকে খবর দেওয়া হয়েছে। পুলিশের ‘স্পেশাল অপারেশন গ্রুপ’ ও সাইবার থানার আধিকারিকেরাও ঘটনাস্থল ঘুরে নমুনা সংগ্রহ করেন।
ওই বাড়িতে থাকেন শম্পা মণ্ডল নামের সব্যসাচীর এক দূর সম্পর্কের কাকিমা। তিনি বলেন, “ও শুক্রবার প্রণাম করল। আর এ দিন সকালে এই ঘটনা শুনছি! রাতে কী ঘটেছে, কিছুই জানি না।’’
পরিবার সূত্রে জানা যায়, নিহতের বাবারা তিন ভাই। দেবকুমার বড়। তাঁর পরিবারের সঙ্গে ১৫ বছর ধরে মূলত ছোট ভাইয়ের পারিবারিক সম্পত্তি ও ব্যবসার ভাগ নিয়ে অশান্তি চলছে। নিহতের মা রত্না বলেন, “সব্যসাচী আমার একমাত্র ছেলে। দেরিয়াপুরের বাড়িতে চেনা লোক না হলে ঢুকতে পারবে না।’’