প্রার্থী নন, প্রতীকটাই যথেষ্ট— কয়েক দশক ধরে এলাকা হাতের মুঠোয় রাখার সময়ে দাবি করতেন বামপন্থীরা। ২০১১ সালে ‘পরিবর্তনের’ ভোটেও এই বিধানসভা কেন্দ্র দখলে রেখেছিল সিপিএম। কিন্তু ২০১৬ সালে তা কেড়ে নিয়েছে তৃণমূল। খণ্ডঘোষের বাসিন্দাদের দাবি, ক্ষমতার হাতবদল হলেও একটি বিষয়ে কোনও পরিবর্তন আসেনি— ভোটের সময়ে অশান্তি।
এ বার লোকসভা ভোটের প্রচার-পর্বে বিজেপি এবং কংগ্রেস প্রার্থীদের বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে কয়েক দফায়। গত রবিবার খুন হয়েছেন এক শেখ কামরুল নামে এক ব্যক্তি। তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে চাপান-উতোর তৈরি হয় সিপিএম-তৃণমূলে। এলাকাবাসীর অনেকের অভিযোগ, ২০০৮ সালে পঞ্চায়েত ভোটের সময় থেকে যে খুনখারাপির রাজনীতি শুরু হয়েছিল, তা এখনও চলছে।
খণ্ডঘোষ ব্লকের ১০টি ও গলসি ২ ব্লকের ৭টি পঞ্চায়েত নিয়ে গঠিত বিষ্ণুপুর লোকসভা আসনের অন্তর্গত এই বিধানসভা কেন্দ্র। তবে এই দু’টি ব্লক দামোদর, বাঁকা ও ডিভিসির মূল সেচখাল দিয়ে বিচ্ছিন্ন। এ ছাড়া এলাকার পাশ দিয়ে গিয়েছে দ্বারকেশ্বর নদী। স্বাধীনতার পরে কংগ্রেস জমানাতেও এই বিধানসভায় দু’বার জেতে বামেরা। ১৯৭৭ থেকে ২০১১ পর্যন্ত বড় ব্যবধানেই জিতে এসেছে তারা। কিন্তু ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে প্রায় ২২ হাজার ভোটে এগিয়ে যায় তৃণমূল। ২০১৬-র বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের প্রার্থী হন বিদায়ী সিপিএম বিধায়ক নবীনচন্দ্র বাগ। তিনি জিতলেও তৃণমূলের সঙ্গে সিপিএমের ব্যবধান নেমে আসে হাজার তিনেকে। গত বছর পঞ্চায়েত ভোটে খণ্ডঘোষে একটি জেলা পরিষদ আসন ছাড়া কোথাও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিল না বিরোধীরা।
মূলত কৃষির উপরে নির্ভরশীল এলাকার জীবিকা। খণ্ডঘোষে সুগন্ধি ধান ও পাশের গলসি রত্না, মিনিকিট ধান ফলান বহু চাষি। এ ছাড়াও খণ্ডঘোষে ৩৫টি ইটভাটা ও গোটা বিধানসভা এলাকায় ৫০টি চালকলে কয়েক হাজার শ্রমিক কাজ করেন। চাষিদের বড় অংশের অভিযোগ, চার দিকে নদী, সেচখাল থাকলেও জলের অভাবে চাষ মার খাচ্ছে। দুই ব্লকেই বোরো চাষের এলাকা কমেছে। আরও ক্ষোভ, নদীর ধার বরাবর একটা বড় অংশ জুড়ে আলু চাষ হত। নদীর ভাঙনের জন্যে তা বন্ধ হতে বসেছে। ইটভাটা ও চালকলের শ্রমিকদেরও ক্ষোভ রয়েছে নানা সমস্যা নিয়ে।
এই ক্ষোভকেই শক্তি করে এগোতে চাইছে বিরোধীরা। জমি ধরে রাখার লড়াইয়ে নেমেছে সিপিএম। দলের নেতা দেশবন্ধু হাজরা, মফুজ হোসেনদের দাবি, “আগের দু’টি ভোটে সগড়াই, শাঁকারি ১-সহ বেশ কয়েকটি পঞ্চায়েত এলাকার বুথে বহিরাগত দুষ্কৃতীরা এসে ভোট-লুট করে। তাদের সঙ্গে লড়াই করা যায়নি। আমরা চাই, সীমানা এলাকা ‘সিল’ করে দেওয়া হোক।’’
গলসিতে আবার দেখা যাচ্ছে গেরুয়া পতাকা-ফেস্টুন। তবে সেখানে বিজেপির অন্দরের দ্বন্দ্বও বেরিয়ে পড়ছে। বিজেপির একটি সূত্রের দাবি, দলে কোন্দলের জন্য ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেবের সভা ‘বয়কট’ও করেছিল একটি গোষ্ঠী। যদিও দ্বন্দ্বের কথা মানতে চান না নেতারা। তাদের দাবি, বামেদের টপকে তারাই এখন তৃণমূলের প্রধান প্রতিপক্ষ। ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ভোটে তাদের উপরেই তৃণমূল আক্রমণ চালিয়েছে। তার পরেও জেলা পরিষদ থেকে প্রার্থী প্রত্যাহার করাতে পারেনি শাসকদল। বিজেপি নেতা বিজন মণ্ডলের অভিযোগ, “আমাদের প্রার্থীর গাড়ির উপরে তিন বার আক্রমণ হয়েছে। তার পরেও পিছিয়ে যাননি আমাদের কর্মীরা। আমরাও ভোট-লুট রুখতে দল তৈরি করেছি। সেই ভরসায় মানুষও আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন।’’
এলাকা দখলে থাকলেও সমস্যা রয়েছে শাসকদলের অন্দরেও। গলসিতে তৃণমূল ও যুব তৃণমূলের মধ্যে গোলমালের ঘটনা বারবারই প্রকাশ্যে এসেছে। প্রচার-পর্ব শেষ হতে চললেও যুব তৃণমূলের বড় অংশকে রাস্তায় তেমন দেখা যায়নি বলে দল সূত্রের খবর। তবে এ সব আমল দিতে নারাজ তৃণমূলের এই বিধানসভা এলাকার পর্যবেক্ষক উত্তম সেনগুপ্ত। তাঁর পাল্টা দাবি, “ভোট লুট তো সিপিএম করত। এখন বিজেপি করছে ত্রিপুরায়। ২০১৪ ও ২০১৬ সালে মানুষ নিজের ভোট দিয়েছেন, এ বারও দেবেন।’’
গরম হাওয়ার মধ্যে রবিবারের ভোটের অপেক্ষায় খণ্ডঘোষ।