বাঁ দিকে, মন্তেশ্বরের মালডাঙায় রাস্তায় বইছে জল। শনিবার। ছবি: উদিত সিংহ ও সুদিন মণ্ডল
কোথাও বাঁকা নদী উপচে গিয়েছে, কোথাও আবার কুনুর বা খড়ি নদী। বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পরেও জলমগ্ন পরিস্থিতি পূর্ব বর্ধমানের নানা এলাকার। এরই মধ্যে ভাতারের মহাপ্রভুতলায় জলে টইটুম্বুর হয়ে থাকা পুকুরে ডুবে মৃত্যু হল বছর দু’য়েকের একটি শিশুর। বর্ধমান শহরের বিভিন্ন এলাকাও জলমগ্ন হয়ে রয়েছে। শহরের বিদ্যার্থী গার্লস হাইস্কুলের সামনের রাস্তা থেকে ভিতরের মাঠ জলমগ্ন থাকায় নার্সিংয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষা দিতে আসা পরীক্ষার্থী থেকে স্কুলের শিক্ষিকারা সমস্যায় পড়েন।
ভাতারে মৃত শিশু লোকনাথ মাঝির পরিজনেরা জানান, তার বাবা তাপস মাঝি পেশায় জেলে। শনিবার সকালেই মাছ ধরতে বেরিয়ে যান তিনি। মা চন্দনাদেবী সংসারের কাজকর্ম করছিলেন। পরিজনদের দাবি, অনেকক্ষণ শিশুটির দেখা না পেয়ে খোঁজ শুরু হয়। দেখা যায়, বাড়ির পাশে একটি পুকুরে শিশুটির দেহ ভাসছে। চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে মৃত বলে জানানো হয়।
বৃষ্টি থামলেও বর্ধমান শহরে বাঁকা নদীর ধারে থাকা এলাকাগুলি এ দিনও জলমগ্ন হয়ে থাকে। পুরসভার দাবি, নতুন করে কোনও এলাকা জলমগ্ন না হলেও, বাঁকার জল ফুলেফেঁপে থাকায় নিকাশির জল আটকে পড়ছে। বিধায়ক (বর্ধমান দক্ষিণ) খোকন দাস বলেন, ‘‘নতুন করে শহরের কোনও এলাকা জলমগ্ন হয়নি। যে সব জায়গায় ত্রাণ শিবির চলছে, সেখানে মানুষজনদের কাছে খাবার ও জল পৌঁছে দেওয়ার কাজ চলছে।’’ বর্ধমানের বিধানপল্লির আশ্রমপাড়া থেকে ২৫ নম্বর ওয়ার্ডে জলমগ্ন এলাকার বাসিন্দাদের একাংশ ত্রাণ নিয়ে ক্ষোভ জানান। আশ্রমপাড়ার বাসিন্দাদের একাংশের দাবি, বাড়ি ছেড়ে অনেকেই ত্রাণ শিবিরে যেতে পারেননি, পাশে কোনও বড় বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু ত্রাণ পাচ্ছেন না। তবে বিধায়ক দেখে যাওয়ার পরে কেউ কেউ ত্রিপল পেয়েছেন বলে জানান। আবার ত্রাণ শিবিরে থাকা অনেকর দাবি, রাতে খাবার মিলছে না। পর্যাপ্ত জলেরও ব্যবস্থা নেই। পুরসভা সূত্রে জানা যায়, ত্রাণ শিবিরগুলিতে শুকনো খাবার দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি সংস্থা ত্রাণ শিবির ও জলমগ্ন এলাকায় গিয়ে খাবার বিলি করছে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, দুর্গাপুর ব্যারাজের কোনও দিকে সেচ খাল দিয়ে শনিবার জল ছাড়া হয়নি। দামোদরে এ দিন সকালে এক লক্ষ ২৭ হাজার কিউসেক জল ছাড়া হলেও, দুপুরের পর থেকে তা কমে। বর্ধমান পুরসভার নির্বাহী আধিকারিক অমিত গুহ বলেন, ‘‘বাঁকার জল কমতে শুরু করলেই বর্ধমান শহরে জল নামতে শুরু করবে।’’ পুরসভা সূত্রে জানা যায়, শহরে ২২টি ত্রাণ শিবির চলছে। এখনও পর্যন্ত হাজার দু’য়েক মানুষ সেগুলিতে আশ্রয় নিয়েছেন। প্রায় ৫৭টি এলাকা জলমগ্ন হয়ে রয়েছে। গোটা পঞ্চাশ বাড়ি সম্পূর্ণ বা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ দিন শহরের নির্মল ঝিল এলাকায় দেখা যায়, নৌকা নামিয়ে মোটরবাইক-সহ বিভিন্ন সামগ্রী জলমগ্ন এলাকার বাইরে পৌঁছে দেওয়ায় উদ্যোগী হয়েছে যুব তৃণমূল। সংগঠনের নেতা সৃজন কুণ্ডুর দাবি, ‘‘পাঁচ দিন ধরে আমরা এই কাজ করছি। প্রথমে বয়স্কদের উদ্ধার, তার পরে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নানা শংসাপত্র উদ্ধার করা হয়েছে। নৌকায় ত্রাণসামগ্রীও পৌঁছনো হচ্ছে।’’
বর্ধমানের ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে সেচখালের উপরে থাকা লকগেট ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়ে। স্থানীয় যুবকেরা টিন-বালির বস্তা দিয়ে জল আটকানোর চেষ্টা করেন। এলাকা পরিদর্শন করেন দামোদর ক্যানাল ডিভিশনের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী বাস্তুকার (ইই) ললিত সিংহ। ওই এলাকার বাসিন্দ, জেলা যুব তৃণমূল সভাপতি রাসবিহারী হালদার বলেন, ‘‘ওই লকগেট দ্রুত মেরামতের দাবি জানানো হয়েছে। সেচ দফতর আশ্বাস দিয়েছে।’’
রায়নার রামানন্দপুরে মাঠের জল গ্রামে ঢুকছে দেখে স্থানীয় বাসিন্দারা পিচের রাস্তা কেটে দেন বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে। শনিবার সেখানে যাতায়াতে অস্থায়ী বাঁশের সেতু তৈরি করেছে পঞ্চায়েত। গুসকরায় কুনুর উপচে কিছু এলাকায় জল ঢুকেছে বলে এলাকাবাসী জানান। এ ছাড়া মেমারির জাবুইডাঙা, খণ্ডঘোষ ও ভাতারের নানা এলাকাতেও জল জমে। মন্তেশ্বরে এ দিন জল জমা আমাটিয়া ও ভাবরুপুর এলাকা পরিদর্শন করেন মহকুমাশাসক (কালনা) সুরেশকুমার জগৎ-সহ প্রশাসন ও পুলিশের কর্তারা। মহকুমাশাসক জানান, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় মানুষজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলা হয়েছে। খড়ি নদীর জল বেড়ে যাওয়ায় মেমারি-মালডাঙা ও মালডাঙা-মালম্বা রাস্তার উপর দিয়ে জল বইতে শুরু করেছে।