বধূ নির্যাতন ও অপহরণের অভিযোগে পুলিশ স্বামীকে গ্রেফতার করেছিল আগেই। অপহরণের চল্লিশ দিন পরে, ১৩ অগস্ট শিলিগুড়ি থেকে নিজের চেষ্টায় বহরমপুরের বাড়ি ফিরে বছর আঠাশের ওই বধূ এ বার পুলিশের কাছে অভিযোগ জানালেন, স্বামী দিগন্ত বিশ্বাস ওরফে পিকাই তাঁকে মোটা টাকার বিনিময়ে তুলে দিয়েছিল পাচারকারীদের হাতে। তিন বছরের শিশুপুত্রকে খুন করে দেওয়ার হুমকি দেখিয়ে শিলিগুড়ির একটি বাড়িতে তাঁকে দিনের পর দিন ধর্ষণ করেছে সেলিম নামে পাচারকারীদের একজন। সোমবার বহরমপুর ফৌজদারি আদালতের জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (তৃতীয় আদালত) সুকুমার মণ্ডলের কাছে এই বিষয়ে গোপন জবানবন্দি দিলেন ওই বধূ। মুর্শিদাবাদের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুখেন্দু হীরা বলেন, ‘‘ফিরে আসার পরে ওই মহিলা গোটা বিষয়টিই জানিয়েছেন। সেই মতো তদন্তও শুরু হয়েছে।’’
পুলিশ ও পারিবারিক সূত্রে জানা গিয়েছে, গত ৫ জুলাই বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়ে যান ওই বধূ। পরের দিন, তাঁর বাবা বহরমপুর থানায় জামাইয়ের বিরুদ্ধেই অপহরণের অভিযোগ দায়ের করেন। ওইদিনই পুলিশ দিগন্তকে গ্রেফতার করে। বর্তমানে সে জেল হেফাজতে রয়েছে। শিলিগুড়ি থানার পুলিশ আধিকারিকেরা জানান, ওই বধূ গত ১২ অগস্ট মহানন্দা সেতু লাগোয়া এয়ারভিউ মোড়ের ট্রাফিক পুলিশের কাছে গিয়ে জানান, তাঁকে অপহরণ করা হয়েছিল। ওই বধূ দাবি করেন, সেখান থেকে তিনি কোনওরকমে পালিয়ে এসেছেন। এর পরে পুলিশ তাঁকে শিলিগুড়ি থানায় নিয়ে যায়। শিলিগুড়ির পুলিশ বহরমপুরে যোগাযোগ করলে ওই বধূর মা শিলিগুড়ি গিয়ে তাঁকে নিয়ে আসেন।
শিলিগুড়ি পুলিশের দাবি, বধূটি প্রথমে জানান, তিনি বাড়িতে ঘুমিয়ে থাকার সময়ে তাঁকে মুখে রুমাল চেপে ধরে অজ্ঞান করে অপহরণ করা হয়েছে। কিন্তু, বাড়ির মধ্যে থেকে সেটা কী ভাবে সম্ভব হল? পুলিশের কাছে দ্বিতীয় দফায় ওই বধূ দাবি করেন, তিনি শৌচাগারে যাওয়ার সময়ে তাঁকে অজ্ঞান করে অপহরণ করা হয়েছে। তিনি পুলিশকে জানান, তাঁকে অপহরণের পরে শিলিগুড়ির আশেপাশে কোথাও একটি দোতলা বাড়িতে রাখা হয়। তবে সেটি নিষিদ্ধপল্লি নয়। ওই বাড়িতে জনৈক সেলিম নামে বছর চল্লিশের এক ব্যক্তি তাঁকে ধর্ষণ করত। তবে সেলিম কে তা তিনি জানেন না বলে দাবি করেছেন পুলিশের কাছে। পুলিশ জানায়, ঘটনার দিন তাঁকে গাড়িতে শিলিগুড়ির কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। মহানন্দা সেতুর কাছে গাড়িটি থামলে সুযোগ বুঝে তিনি দরজা খুলে লাফিয়ে ট্রাফিক পুলিশের দ্বারস্থ হন।
ওই বধূর বাবা অবসরপ্রাপ্ত পুলিশকর্মী। মা স্বাস্থ্য দফতরের প্রাক্তন কর্মী। ওই বধূ নিজেও বহরমপুর গার্লস কলেজ থেকে বিএ পাশ করেছেন। ২০০৭ সালে বাড়ির অমতে তিনি ভালবেসে বিয়ে করেন বহরমপুরের বানজেটিয়ার বাসিন্দা দিগন্তকে। তাঁদের সাড়ে তিন বছরের এক শিশুপুত্র রয়েছে। ওই বধূর অভিযোগ, বিয়ের এক মাস পর থেকেই তাঁর স্বামী ও শ্বশুর পণের জন্য অত্যাচার শুরু করে। বাপের বাড়ি থেকে টাকা না আনলে তাঁর ঘরে অন্য পুরুষ ঢুকিয়ে দেওয়ারও হুমকি দেওয়া হত। গত ৫ জুলাই দিগন্ত তাঁকে অপরিচিত কয়েকজনের হাতে তুলে দেয় বলে অভিযোগ।
ওই বধূ বলেন, ‘‘সেলিম বলে ওই লোকটা আমাকে দিনের পর দিন ধর্ষণ করেছে। রাজি না হলে মারধরের পাশাপাশি আমার ছেলেকে খুন করে দেওয়ার হুমকি দিত। কথায় কথায় ওরা আমার স্বামীকে ধন্যবাদ দিত।’’ ওই বধূর বাবার অভিযোগ, ‘‘আমি নিজে একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশকর্মী। অথচ আমি নিজে অভিযোগ জানানোর পরেও মেয়েকে উদ্ধারের ব্যাপারে জেলা পুলিশ কিছুই করেনি। পুলিশ যদি প্রথম থেকেই বিষয়টিতে গুরুত্ব দিত তাহলে গোটা পাচার চক্রটাকেই ধরা যেত।’’
যদিও এমন অভিযোগ মানতে চাননি জেলা পুলিশের কর্তারা। জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুখেন্দু হীরা বলেন, ‘‘অভিযোগ পাওয়ার পরেই ওই বধূর স্বামীকে আমরা গ্রেফতার করেছি। ফিরে আসার পরে ওই বধূর ধর্ষণ-সহ যাবতীয় অভিযোগের আমরা তদন্ত শুরু করেছি। আশা করছি ওই পাচার চক্রের সদস্যদেরও আমরা খুব শীঘ্র ধরতে পারব।’’
এ দিন আদালত থেকে জবানবন্দি দিয়ে ফেরার পথে ওই বধূ বলেন, ‘‘কী ভাবে আমার স্বামী আমাকে পাচারকারীদের হাতে তুলে দিয়েছে, কী ভাবে সেলিম আমার উপর অত্যাচার করেছে—এ সবই আমি বিচারককে জানিয়েছি। পিকাইকে ভালবেসে, বিশ্বাস করে একদিন ঘর ছেড়েছিলাম। আজ তার শাস্তির জন্য যত দূর যেতে হয় আমি যাব।’’