রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস। —ফাইল চিত্র।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-মৃত্যুর ঘটনার প্রেক্ষিতে আরও সক্রিয় হলেন আচার্য তথা রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস। যাদবপুরের জন্য ‘অ্যাকশন প্ল্যান’ তৈরি এবং শীঘ্রই তা প্রকাশ্যে আসবে বলে জানালেন তিনি। সেই সঙ্গেই আজ, বুধবার বিকালে রাজভবনে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্টের বৈঠক ডাকলেন আচার্য।
র্যাগিংয়ের জেরেই যাদবপুরে প্রথম বর্ষের ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে, এই অভিযোগে রাজ্য রাজনীতিতে কয়েক দিন ধরে তোলপাড় চলছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সোমবারই মুখ খুলে ঘটনার জন্য বামেদের (‘মার্ক্সবাদী’) দিকে আঙুল তুলেছেন। তার আগেই রাজ্যপাল যাদবপুর-কাণ্ডে সক্রিয়তা দেখিয়েছেন, র্যাগিং বন্ধ করতে পৃথক কমিটি গঠন করার কথাও জানিয়েছেন। স্বাধীনতা দিবসে আরও এক ধাপ এগিয়ে রাজ্যপাল বোস বলেছেন, ‘‘রাতের অন্ধকার থাকলে দিনের আলোও আসবে। শিক্ষক, সহ-উপাচার্য, ছাত্র, বিশিষ্ট জন এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আমি কথা বলছি। অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি হচ্ছে, শীঘ্রই প্রকাশ্যে আসবে। আপনারা সবাই জানতে পারবেন।’’ যাদবপুরের উপাচার্য নিয়োগের বিষয়েও তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত হবে বলে মঙ্গলবার রাজ্যপাল জানিয়েছেন।
স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে এ দিন সন্ধ্যায় রাজভবনের চা-চক্রের আয়োজন হয়েছিল। সেখানে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। প্রাক্-স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান থেকে ২৪ ঘণ্টা আগেই রাজ্যপাল বোসকে আক্রমণ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সংঘাতের আবহেও এ দিন অবশ্য দু’জনের সাক্ষাৎ ও সৌজন্য বিনিময় হয়েছে। রাজভবন থেকে বেরিয়ে মুখ্যমন্ত্রী কোনও মন্তব্য করতে চাননি। আর ওই অনুষ্ঠানের শেষেই রাজ্যপাল যাদবপুর সংক্রান্ত তাঁর ভাবনার কথা জানিয়েছেন।
রাজ্যপালের বক্তব্য বা কোর্টের বৈঠক ডাকার সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু রাত পর্যন্ত মুখ খোলেননি। তবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক পার্থপ্রতিম রায়ের বক্তব্য, ‘‘র্যাগিং একটি সামাজিক ব্যাধি। এই ব্যাধিকে নির্মূল করতে সমস্ত রকম রাজনীতি ভুলে সকলকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। এটা যদি সকলে বোঝেন, তা হলে ভাল।’’
যাদবপুরের ঘটনা নিয়ে এবং র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মতামতও অব্যাহত। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সংবিধান, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষা করার ডাক দিয়ে এ দিন বামেদের কর্মসূচি ছিল সারা রাজ্যে ও দেশে। আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে সিপিএমের রাজ্য দফতরের ছাদে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের পরে এন্টালি বাজারে সভায় গিয়েছিলেন বিমান বসু, মহম্মদ সেলিম, সূর্যকান্ত মিশ্রেরা। সেখানেই বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান ও প্রবীণ নেতা বিমানবাবু বলেন, ‘‘আমরা ছাত্র আন্দোলন করেছি। ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে এসেছি। এই রকম জিনিসের (র্যাগিং) কথা ভাবতে পারতাম না! ছাত্রেরা ছাত্রদের পাশে থেকেছে সব সময়। আমাদের যেতে হত হাসপাতালে।’’ ছাত্র-মৃত্যুর ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না বলে উল্লেখ করে তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘এসএফআই সব সময়েই র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে।’’
আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের ছাদে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের অনুষ্ঠানে বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্র প্রমুখ। —নিজস্ব চিত্র।
বহরমপুরে এ দিনই প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর অভিযোগ, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা নেই, প্রশাসন নেই। তার জন্যই যাদবপুরের ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করি। রাজ্য সরকার ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছিল। মানুষের বিক্ষোভে সরকার বাধ্য হচ্ছে কিছু পদক্ষেপ নিতে। এর ঘাড়ে, তার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর সরকারের ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা করলে মানুষ মেনে নেবে না!’’ র্যাগিং শুধু যাদবপুরে সীমাবদ্ধ নয় বলে দাবি করে অধীর আরও বলেছেন, ‘‘মৃত ছাত্রের বাড়ি কাল গিয়েছিলাম। ওঁর বাবা-মা দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান। মুখ্যমন্ত্রীকে দায়িত্ব নিতে হবে।’’
রাজ্য তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ আবার এ দিন বলেছেন, ‘‘র্যাগিংয়ের মতো কুৎসিত সংস্কৃতি ওখানে চলছিল। ঘটনার প্রতিবাদ করতে বা ছেলেটাকে আগলে রাখতে কেউ আসেনি। দোষীদের শাস্তি আমরা চাই। যারা দোষীদের আড়াল করছে, তাদেরও শাস্তি চাই।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘এই ব্যবস্থাটার সংশোধন চাই। ওই জায়গাটাকে (যাদবপুর) বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো করে রাখা হয়েছে! আন্দোলনের নামে ওখানে অসভ্যতা হয়েছে, বাবুল সুপ্রিয়কে শারীরিক হেনস্থা করা হয়েছে। বামেদের নানা গোষ্ঠী রয়েছে। তাদের তরফে ঘটনাটার নিন্দা নেই, লোক দেখানো নানা কথা বলছে। ওখানে তৃণমূলের ছাত্র সংগঠন যেমন আন্দোলন করবে, তেমনই প্রশাসন দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। ব্যবস্থাটা (সিস্টেম) ঠিক করার চেষ্টা করবে।’’ যাদবপুরের ৮বি বাসস্ট্যান্ডে আজ, বুধবারই দিনভর ধর্নার ডাক দিয়েছে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ।
সিপিআই (এম-এল) লিবারেশনের অভিযোগ, ছাত্র-মৃত্যুর ঘটনার পরে এখন কেন্দ্রীয় সংস্থা জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, ইউজিসি এবং রাজভবন যেন সিবিআই আর ইডি-র ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে শুধু যাদবপুর নয়, বাংলার ছাত্র আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের বিলুপ্তি ঘটিয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদের মান্যতা ও ছাত্রদের রাজনীতি করার অধিকার হরণ করতে এবং ‘নিরঙ্কুশ দক্ষিণপন্থী আধিপত্য’ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। লিবারেশনের রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদারের দাবি, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁর অযাচিত, উদ্দেশ্যমূলক মন্তব্য (‘আতঙ্কপুর’ এবং বামেদের দোষারোপ) ফিরিয়ে নিতে হবে, নাবালক ছাত্রের হত্যার বিচারবিভাগীয় তদন্ত করে দোষীদের দ্রুত শাস্তি দিতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে অবিলম্বে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ করতে হবে এবং ছাত্র মৃত্যুর অজুহাতে ছাত্র সংগঠনগুলির উপরে পুলিশি হামলা নামিয়ে আনা চলবে না।’’
(পশ্চিমবঙ্গ শিশু সুরক্ষা কমিশনের উপদেষ্টা অনন্যা চক্রবর্তী রবিবার তাঁর একটি ফেসবুক পোস্টে যাদবপুরের মৃত ছাত্রের নাম না-লিখতে অনুরোধ করেছেন। এই মৃত্যুমামলা অপ্রাপ্তবয়স্কদের উপর যৌন নির্যাতন বিরোধী ‘পকসো’ আইনে হওয়া উচিত বলেও তাঁর অভিমত। কমিশনের উপদেষ্টার অনুরোধ মেনে এর পর আনন্দবাজার অনলাইন মৃত ছাত্রের নাম এবং ছবি প্রকাশে বিরত থাকছে।)