বারো বছর আগের প্রকল্প। না এক ইঞ্চি এগোয়, না বাতিল হয়। এ বার সেই ক্যানিং-ঝড়খালি রেলপথের প্রকল্পের জন্য কেন্দ্রীয় বাজেটে বরাদ্দ হয়েছে ১ টাকা!
এত দিন বাজেটের দিকে কান পেতে থাকতেন সুন্দরবনবাসী। রেলপথের চাহিদা তাঁদের অনেক দিনের। এ বার বাজেট শেষে তাঁরা জানতে পারলেন, প্রকল্প বাতিল হয়নি। তবে বরাদ্দ ১ টাকা। কেন এমন বিচিত্র সিদ্ধান্ত কেন্দ্রের, তা জানেন না কেউ। রেলপথের দাবিতে দীর্ঘ দিন আন্দোলনের মূল মুখ লোকমান মোল্লার মতে, ‘‘এই বরাদ্দ বুঝিয়ে দিচ্ছে, প্রকল্পটি এখনও মাথায় রেখেছে কেন্দ্র। কিন্তু তা বোঝাতে গিয়ে যে পদক্ষেপ করা হল বাজেটে, তা শুধু হাস্যকরই নয়, এক অর্থে সুন্দরবনের মানুষের সঙ্গে নির্মম রসিকতা।’’ লোকমান জানান, এ বার নাগরিক মঞ্চ গঠন করে নাগরিক কনভেনশনের মধ্যে দিয়ে রেলপথের দাবিতে আন্দোলনের পথে হাঁটতে চলেছেন সুন্দরবনবাসী।
তেরো বছর আগে সুন্দরবনে রেললাইন সম্প্রসারণের জন্য দাবি তুলেছিলেন মানুষজন। তৎকালীন লোকসভার অধ্যক্ষ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে গণস্বাক্ষর করে দাবি পেশ করা হয়। সুন্দরবনবাসীর সেই দাবি মেনে ২০০৯ সালে রেলমন্ত্রী থাকাকালীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্যানিং থেকে ঝড়খালি পর্যন্ত রেললাইনের শিলান্যাস করেছিলেন। শুরু হয়েছিল কাজ। মাতলা নদীর উপরে রেলসেতু নির্মাণের জন্য ২১টি কংক্রিটের স্তম্ভও তৈরি হয়।
কিন্তু ওই পর্যন্তই। বছরের পর বছর কেটে গেলেও কাজের অগ্রগতি হয়নি। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে বাসন্তীতে সুন্দরবন কৃষ্টিমেলা ও লোকসংস্কৃতি উৎসবে যোগ দিতে আসেন তৎকালীন লোকসভার অধ্যক্ষ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। সে সময়ে দক্ষিণ সুন্দরবনের মানুষজন তাঁর কাছে সুন্দরবনে রেলপথ সম্প্রসারণের জন্য আর্জি জানান। দিল্লিতে ফিরেই সুন্দরবনবাসীর সেই দাবি খতিয়ে দেখে এ বিষয়ে পদক্ষেপ করার জন্য তৎকালীন রেলমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদবকে ২০০৯ সালের ২ জানুয়ারি চিঠি লিখেছিলেন অধ্যক্ষ।
এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারে রদবদল হয়। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সে সময়ে রেলমন্ত্রী হন। সুন্দরবনবাসীর দাবি মাথায় রেখে প্রথমে ক্যানিং থেকে ভাঙনখালি পর্যন্ত ৪.৮৪ কিমি ও পরে আরও দুই দফায় ভাঙনখালি থেকে সোনাখালি পর্যন্ত ১৪.০৩ কিমি ও সোনাখালি থেকে ঝড়খালি পর্যন্ত আরও ২৩ কিমি রেলপথ সম্প্রসারণের কথা ঘোষণা করেন। সে বছরই ১৪ নভেম্বর ক্যানিংয়ে শিলান্যাস অনুষ্ঠান হয়। সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে যায় রেলপথ সম্প্রসারণের কাজ। প্রায় দেড়শো কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্দ ধরা হয় মাতলা নদীর উপরে রেলসেতু তৈরির জন্য। কিন্তু সেই টাকায় নদীর উপরে কয়েকখানি কংক্রিটের খুঁটি তৈরি ছাড়া কিছুই হয়নি।
এরপরে মাতলা নদীতে অনেক জোয়ার-ভাটা খেলেছে। কিন্তু এই ৪২ কিমি রেলপথ সম্প্রসারণের কাজ একচুলও এগোয়নি। প্রতিবার বাজেটের আগে আশায় বুক বাঁধেন সুন্দরবনের মানুষজন। কিন্তু বাজেট ঘোষণার পরে হতাশা ছাড়া আর কিছুই তাঁদের কপালে জোটে না।
সুন্দরবন উন্নয়ন পর্ষদের প্রাক্তন সদস্য তথা এই নাগরিক কনভেনশনের অন্যতম উদ্যোক্তা লোকমান মোল্লা বলেন, ‘‘ঝড়খালি পর্যন্ত রেলপথ সম্প্রসারণ হলে একদিকে যেমন দেশ-বিদেশের পর্যটকেরা সরাসরি সুন্দরবনে আসতে পারতেন, তেমনই সুন্দরবনের লক্ষ লক্ষ মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মানোন্নয়ন ঘটবে। এই রেলপথ সম্প্রসারণের কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে তৎকালীন রেল দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী অধীররঞ্জন চৌধুরী, সুরেশ প্রভু, রাজেন গহিন থেকে শুরু করে বর্তমান রেলমন্ত্রী পীযূষ গোয়েলকে আবেদন করেছি, এমনকী এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়ে চিঠি দিয়েছি। তবু কোনও লাভ হয়নি। এ বার বাজেটেও বঞ্চিত রইলেন সুন্দরবনবাসী। মাত্র ১ টাকা বরাদ্দ হয়েছে এই বাজেটে। এটাই বোধহয় এই শতাব্দীর সেরা প্রহসন।’’
রেল দফতর সূত্রের খবর, প্রধানমন্ত্রীর দফতরের নির্দেশে রেল দফতরের তরফ থেকে ক্যানিং ঝড়খালি রেলপথ সার্ভের কাজ ইতিমধ্যেই শেষ হয়েছে। জমি অধিগ্রহণের জন্য দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি রেলসেতুর কাজ পুনরায় শুরু করা হয়েছে বলে লোকমানকে ইতিমধ্যেই চিঠিতে জানানো হয়েছে। কিন্তু রাজ্য সরকারকে জমি অধিগ্রহণ করার আবেদন জানানো হলেও সে বিষয়ে তেমন কোনও উদ্যোগ করা হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। সে কারণেই এই রেলপথ সম্প্রসারণের কাজও আর এগোয়নি।
এ বিষয়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসনের কোনও আধিকারিকই মুখ খুলতে রাজি হননি।