বিকল্প: হাসপাতালের উপরে ভরসা না রেখে চিকিৎসা চলছে কামিনুলের ঘরে। ছবি: সজলকুমার চট্টোপাধ্যায়
জ্বরে ভুগছিলেন সকলেই। হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা হয়। কাউকে কাউকে ‘সুস্থ’ বলে ছেড়ে দেওয়া হয় ক’দিন বাদে। কিন্তু বাড়ি ফিরে মারা গিয়েছেন তাঁদের মধ্যে ২ জন। সোম ও মঙ্গলবারের মধ্যে উত্তর ২৪ পরগনার নানা প্রান্তে আরও ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে জ্বরে ভুগে। সব মিলিয়ে সংখ্যাটা ৭। বেসরকারি মতে, জ্বরের আক্রমণে এই নিয়ে জেলার গ্রামীণ এলাকায় মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ৭০ ছাড়াল। সরকারি হাসপাতালের উপরে আস্থা হারিয়ে বহু রোগীর পরিবার এখন ভিড় করছেন পল্লি চিকিৎসকদের কাছে।
হাবরার কুমড়ো এলাকার বাসিন্দা শম্পা মণ্ডল (৩২) জ্বর নিয়ে হাবরা হাসপাতালে ভর্তি হন শুক্রবার। রবিবার তাঁকে বারাসত জেলা হাসপাতালে পাঠানো হয়। মঙ্গলবার সেখানেই মারা যান শম্পা। এ দিন বারাসত হাসপাতালে দাঁড়িয়ে তাঁর দাদা চঞ্চল মণ্ডল বলেন, ‘‘বিনা চিকিৎসায় বোনটা মারা গেল।’’
দেগঙ্গা ১ পঞ্চায়েতের আমিনপুর গ্রামের জ্যোংস্না দাস (৬০) জ্বরে আক্রান্ত হয়ে কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন। মঙ্গলবার ভোরে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।
চৌরাশি পঞ্চায়েতের ঢালিপাড়ার বাসিন্দা নাসিরা বিবি (৪৫) জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বারাসত জেলা হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর পরে রবিবার ‘সুস্থ’ বলে বাড়িতে আনা হয়েছিল। সোমবার সন্ধ্যায় মৃত্যু হয় নাসিরার। স্বামী নাসির হোসেন মোল্লা বলেন, ‘‘কেন সরকারি হাসপাতাল সম্পূর্ণ সুস্থ না করে বাড়িতে পাঠাল, কে জানে।’’
চাকলা পঞ্চায়েতের মঞ্জিলআটি গ্রামের মহব্বত আলি মল্লিক (৫৬) জ্বর নিয়ে বারাসত জেলা হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। রবিবার ‘সুস্থ’ বলে তাঁকেও ছেড়ে দেওয়া হয়। ফের সোমবার রাতে অসুস্থ হয়ে পড়েন মহব্বত।
ওই রাতে হাবরা হাসপাতালে নিয়ে গেলে মঙ্গলবার ভোরে সেখানেই মারা যান তিনি। রোগীর এক আত্মীয় সম্রাট মণ্ডল বলেন, ‘‘সরকারি রিপোর্টে প্লেটলেট নেমে গিয়েছিল। তা সত্ত্বেও তাঁকে ছুটি দিয়ে দেন চিকিৎসকেরা। ওঁরা একটু মানবিক হলেই মৃত্যু হত না।’’
অন্য দিকে, সোমবার চাঁপাতলা পঞ্চায়েতে একই গ্রামে তিন জন মহিলার মৃত্যুর পরে ফের ওই এলাকার বাসিন্দা আর্জিনা বিবির (৩৬) মৃত্যু হল মঙ্গলবার ভোরে। পারিবারিক সূত্রের খবর, তিন দিন ধরে জ্বরে ভুগছিলেন আর্জিনা। সোমবার তাঁকে হাড়োয়া হাসপাতালে নিয়ে গেলে মঙ্গলবার সকালে সেখানেই মারা যান।
বাদুড়িয়ার আটঘরা গ্রামের আবুবক্কর মণ্ডল (২২) বসিরহাট জেলা হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন জ্বর নিয়ে। তিনিও সোমবার রাতে মারা গিয়েছেন। হাসপাতাল থেকে মৃত্যুর কারণ ‘হৃদযন্ত্র বিকল’ বলে লেখা হয়েছে। মঙ্গলবার থেকে আটঘরা গ্রামে ব্লিচিং ছড়ানো এবং মশা মারার তেল দেওয়া শুরু হয়েছে।
মঙ্গলবার সকালে দেগঙ্গার কলসুর পঞ্চায়েতের চৌকিপোতা গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, মারাকপুর গ্রামের মতোই আর এক পল্লি চিকিৎসক কামিনুল বিশ্বাস তাঁর বাড়ির সামনে পড়ে থাকা ৫টি ঘরে জ্বরে আক্রান্ত বহু রোগীর স্যালাইন লাগিয়ে চিকিৎসা করেছেন। ওই গ্রামের বাসিন্দা অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী মঞ্জুরা খাতুনের (১৪) মৃত্যু হয় রবিবার। বারাসত হাসপাতালে চিকিৎসা চলছিল তার।
দেগঙ্গার মাঠপাড়ার সালমা বিবি (২৮) ভর্তি ছিলেন আরজিকরে। তিনিও মারা গিয়েছেন মঙ্গলবার।
গ্রামবাসীদের ক্ষোভ, সরকারি ডাক্তাররা ভাল ভাবে না দেখে কয়েকটা ওষুধ দিইয়ে বাড়ি ফিরিয়ে দিচ্ছেন। এসে ফের জ্বর বেড়ে যাচ্ছে। অন্য দিকে, কামিনুল যতক্ষণ রোগী সুস্থ না হচ্ছে, পাশে থেকে চিকিৎসা করে যাচ্ছেন। স্যালাইন দিচ্ছেন। টাকা-পয়সা নিয়েও চাপ দিচ্ছেন না।
দিন কুড়ি ধরে এই কাজ করছেন বলে জানালেন কামিনুল। তাঁর কথায়, ‘‘সাধ্য মতো চেষ্টা করছি। কেউ টাকা দিচ্ছেন, কেউ দিতে পারছেন না। তাতে কী? গ্রামের মানুষকে তো আগে বাঁচাতে হবে।’’
সাহারুল মণ্ডলকে নিয়ে স্ত্রী আসমা বিবি গিয়েছিলেন দেগঙ্গার বিশ্বনাথপুর ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। আসমা বলেন, ‘‘ডাক্তারেরা জানান, দু’দিন পরে রক্ত পরীক্ষা করে আসতে। তার মধ্যে স্বামীর অবস্থা খারাপ হতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গেই এই পল্লি চিকিৎসকের কাছে নিয়ে আসি। স্বামী এখন সুস্থ। সরকারি ডাক্তারের কথা শুনে ঘরে রাখলে কী যে হত!’’