পুত্রহারা: কান্নায় ভেঙে প়ড়েছেন অনিকেত ছেত্রীর মা। শিলিগুড়ির কিরণচন্দ্র শ্মশানে। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।
পাহাড়ের গায়ে তিস্তা বাজারের কাছে তিস্তা ভ্যালি চা বাগান লাগোয়া এলাকাতেই বাড়ি অনিকেতের (১৭)। বাবা রাজস্থানে একটি হোটেলের কর্মী। মা আর বোনকে নিয়ে পাহাড়ি গ্রামে থাকতেন অনিকেত। খালাসির কাজ করতেন। ২১ জুন মোর্চার আন্দোলনের সময়ই শিলিগুড়ি থেকে ইট ভর্তি ট্রাকে তিস্তা ভ্যালিতেই যাচ্ছিলেন তিনি। কালীঝোরা পর্যন্ত পৌঁছেই গিয়েছিলেন। হঠাৎ ট্রাকে পড়ে পেট্রোল বোমা। আগুন লেগে যায় ট্রাকে। তাতেই ঝলসে যান এই কিশোর। কলকাতার এসএসকেএম-এ চিকিৎসা করিয়েও বাঁচানো যায়নি। বৃহস্পতিবার মারা যান তিনি।
শুক্রবার তাঁর দেহ কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি পৌঁছয়। এ বারে তা তাঁদের পাহাড়ের গ্রামে নিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু হতেই আবার ধাক্কা। বন্ধের মধ্যে পাহাড়ে উঠতে দেওয়া হবে না মৃতের দেহও।
তবে সরাসরি কেউ কিছু বলেননি। শুধু ছেত্রী পরিবার যখনই কোনও গাড়ি চালকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছেন, তাঁরা সামনে থেকে সরে গিয়েছেন। এক চালক শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁকে হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে বলে শোনা যায়। অ্যাম্বুল্যান্স ডাকার কথাও ভাবা হয়। তখন শোনা যায়, তা-ও আনানো যাবে না। অনিকেতের এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বলেন, ‘‘বুঝতেই পারছিলাম, পাহাড়ের নেতাদের নির্দেশ রয়েছে। তাই আমরা আর জোরাজুরি করিনি।’’
আরও পড়ুন: রঞ্জিতের কোর্টে হাজিরা নিয়ে নীতি-সঙ্কটে রাজ্য
এই ঘটনা নতুন নয়। ২০০৮ সালে জিএনএলএফের তৎকালীন সুপ্রিমো প্রয়াত সুবাস ঘিসিঙ্গ তাঁর স্ত্রী ধনকুমারীর দেহ পাহাড়ে নিয়ে যেতে পারেননি। মোর্চার আন্দোলনে তিনি নিজেই তখন পাহাড় ছাড়া। শেষে শিলিগুড়ির কিরণচন্দ্র শ্মশানঘাটেই দাহ করা হয় ধনকুমারীকে। তার ৯ বছর পর অনিকেতের দেহ নিয়েও একই রকম অটল রইল পাহাড়।
বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ, পর্যটন মন্ত্রী গৌতমবাবু শিলিগুড়ির হাসপাতালে মর্গে গিয়ে ফুল দিয়ে অনিকেতকে শ্রদ্ধা জানান। তারপরে তার দেহ নিয়ে যাওয়া হয় কিরণচন্দ্র শ্মশানঘাটে। রাতে রাজ্য পুলিশের ডিজি সুরজিৎ কর পুরকায়স্থও জানান, অনিকেতের পরিবারের এক জনকে চাকরি দেবে সরকার। দেওয়া হবে আড়াই লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণও। গৌতমবাবু বলেন, ‘‘খুন করা হল ছেলেটাকে। তারপরে সাধারণ মানবিকতাও দেখানো হল না।’’ মোর্চার সহকারী সাধারণ সম্পাদক জ্যোতিকুমার রাই এ প্রসঙ্গে কিছুই বলতে চাননি। অনিকেতের মৃত্যু প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য, ‘‘আমরা শোকাহত।’’
শ্মশানে চুপ করে বসেছিল অনিকেতের বোন। বাড়ি নিয়ে যেতে পারল না দাদাকে। হাউহাউ করে কাঁদছিলেন অনিকেতের মা। পুলিশ যে ভাবে এসকর্ট করে অনিকেতের মা আর বোনকে পাহাড় থেকে নামিয়ে এনেছিল, সে ভাবেই অনিকেতের দেহ তোলার কথা বললেও ছেত্রী পরিবার আর রাজি হয়নি। তাঁদের এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের কথায়, ‘‘অনিকেত তো চলে গেল। আমাদের তো থাকতে হবে।’’