হরজিন্দরের খনি থেকে বিশ্বকাপের সাত রত্ন

সেই হরজিন্দর সিংহ, আশির দশকের গোড়ায় যাঁর বাঁ-পায়ের জাদু দেখতে ভরে যেত লাল-হলুদ গ্যালারি। গুরদেব সিংহ, মনজিৎ সিংহদের সঙ্গে পঞ্জাব থেকে ১৯৭৯-তে চলে এসেছিলেন কলকাতায়। গুরদেবরা চলে গেলেও হরজিন্দর থেকে গিয়েছিলেন আরও এক বছর। জিতেছিলেন ফেড কাপ, রোভার্স কাপ।

Advertisement

রতন চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০১৭ ০৪:০০
Share:

শুভেচ্ছা: ক্রীড়ামন্ত্রী রাজ্যবর্ধন সিংহ রাঠৌর সংবর্ধিত করছেন অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপের ভারতীয় দলের অধিনায়ক অমরজিৎ সিংহ-কে। নিজস্ব চিত্র

লুইস নর্টন দে মাতোস কৃতজ্ঞ থাকতে পারেন হরজিন্দর সিংহের কাছে!

Advertisement

অনূর্ধ্ব ১৭ যুব বিশ্বকাপে খেলতে নামার ঐতিহাসিক মুহূর্তে প্রাক্তন এই ভারত অধিনায়কের কাছে কৃত়জ্ঞ থাকতে পারে ফেডারেশনও। জাতীয় যুব দল তৈরির এক বিশাল ভাণ্ডার পর্তুগাল কোচের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য।

সেই হরজিন্দর সিংহ, আশির দশকের গোড়ায় যাঁর বাঁ-পায়ের জাদু দেখতে ভরে যেত লাল-হলুদ গ্যালারি। গুরদেব সিংহ, মনজিৎ সিংহদের সঙ্গে পঞ্জাব থেকে ১৯৭৯-তে চলে এসেছিলেন কলকাতায়। গুরদেবরা চলে গেলেও হরজিন্দর থেকে গিয়েছিলেন আরও এক বছর। জিতেছিলেন ফেড কাপ, রোভার্স কাপ।

Advertisement

ভারতীয় দলে টানা এগারো বছরের উজ্জ্বল ফুটবলার জীবন বা অধিনায়কত্ব নয়, একেবারে অন্তরালে থেকে এমন একটা কাজ হরজিন্দর করেছেন, যা এ দেশের ফুটবল ইতিহাসে বিরলতম বলেই ধরা যেতে পারে। কোনও প্রাক্তন ফুটবলার বা কোচেরই যে কৃতিত্ব নেই।

যুব বিশ্বকাপের ভারতীয় দলে যে ২১ জন ফুটবলার নির্বাচিত করেছেন পর্তুগিজ কোচ মাতোস, তাঁদের এক তৃতীয়াংশ অর্থাৎ সাত জনেরই ফুটবল-গুরু হলেন হরিজন্দর সিংহ। ‘‘২০১১ থেকে ১৬ সাল পর্যন্ত যে শিক্ষার্থীরা আমার অ্যাকাডেমিতে ছিল, তাদের সাত জন বিশ্বকাপ খেলবে, এর চেয়ে আনন্দের কিছু হতে পারে! যে-কোনও কোচের কাছে এটা স্বপ্নের মতো।’’ দিল্লি থেকে ফোনে কথা বলার সময় হরজিন্দরের গলায় আবেগ। মাস খানেক হল অ্যাকাডেমি ছেড়ে দিলেও বলছিলেন, ‘‘আমি আফগানিস্তানে ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপে দেশের অধিনায়কত্ব করেছিলাম। আর আমার তুলে আনা ছেলে অমরজিৎ সিংহ কিয়াম বিশ্বকাপে দেশের অধিনায়কত্ব করছে, এটা যে কী গর্বের, বোঝাতে পারব না। অধিনায়ক হওয়ার পর অমর আমাকে ফোন করেছিল। খবরটা শুনে কেঁদে ফেলেছিলাম। এখনও মনে আছে, আমার এক বন্ধু কোচ মণিপুরের থৈবা সিংহ ওকে পাঠিয়েছিল আমার অ্যাকাডেমিতে। খুব গরিব ওই ছেলেটাকে আমি তৈরি করেছি।’’

চণ্ডীগড় ফুটবল অ্যাকাডেমি সংক্ষেপে সি এফ এ—এখানেই গত সতেরো বছর কোচিং করাচ্ছেন হরজিন্দর। সেখান থেকেই লুই মাতোসের দলে সুযোগ পেয়েছেন সাত ফুটবলার। এঁরা হলেন অমরজিৎ সিংহ, সঞ্জীব স্ট্যালিন, প্রভোসুখান গিল, জ্যাকসন সিংহ, আনোয়ার আলি, ননগোডাম্বা নাওরেম এবং মহম্মদ শাহজাহান। ফোনেই এঁদের সবার ঠিকুজি-কোষ্ঠী গড়গড় করে বলে যেতে পারেন হরজিন্দর। ‘‘আমার অ্যাকাডেমির কথা শুনে সঞ্জীব স্ট্যালিনের বাবা পাঁচ বছর আগে ওকে দিয়ে গিয়েছিল আমার কাছে। আজ সে বিশ্বকাপ টিমের তারকা। তবে মণিপুর আর পঞ্জাবের ছেলেই বেশি ছিল। মণিপুর তো এখন ভারতীয় ফুটবলের পাওয়ার হাউস।’’ জেসিটি বা পঞ্জাব পুলিশ সর্বভারতীয় ফুটবল থেকে সরে দাঁড়ানোর পর পঞ্জাব ফুটবলের দীর্ঘ দিনের গরিমা অস্তাচলে চলে গিয়েছে। কেউ খোঁজও রাখেনি। আইএসএলের কোনও টিম নেই চণ্ডীগড় থেকে। ফ্র্যাঞ্চাইজি টিম হিসাবে যোগ দেওয়া মিনার্ভা প়ঞ্জাব গত বছর থেকে আই লিগ খেললেও অর্থের অভাবে ধুঁকছে। সেখানকার এক অ্যাকাডেমি থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ফুটবলার উঠে আসছে, এটা বেশ চমকপ্রদ। ‘‘জাতীয় দলে সন্দেশ ঝিঙ্গান থেকে রবিন সিংহ, সব আমার অ্যাকাডেমির। এখনও পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন বয়সভিত্তিক টিমে ৫৬ জন ফুটবলার সুযোগ পেয়েছে।’’ বলেই চলেন মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক সময়ের সতীর্থ ফুটবলার।

বাংলা বা গোয়া— ফুটবলের রাজ্য হয়েও যা পারেনি, তা কীভাবে সম্ভব হল? আসলে চণ্ডীগড়ের এই ফুটবল অ্যাকাডেমির পিছনে মাথা ছিল সেখানকার এক প্রাক্তন রাজ্যপাল জেকেএফ জেকবের। তিনি-ই প্রধান কোচ হিসাবে নিয়োগ করেছিলেন হরজিন্দরকে। পঞ্জাব, হিমাচল প্রদেশ, হরিয়ানার গ্রামে গ্রামে ঘুরে তিনি বেছে আনেন প্রতিশ্রুতিমান ফুটবলার। এর পর তাঁর নজর যায় মিজোরাম ও মণিপুরের দিকে। হরজিন্দর বলছিলেন, ‘‘আমাদের সময় প্রতিভাবান ফুটবলার বেশি ছিল। এখন কমে গিয়েছে। তাই উত্তর-পূর্বাঞ্চলের দিকে নজর দিয়েছিলাম। সুফল পেয়েছি। আমি কখনও বিশ্বকাপ খেলিনি, কিন্তু আমার ছাত্ররা তো খেলছে। আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না, বিশ্বকাপ খেলছি বা বিদেশি কোচের কাছে অনুশীলন করছি।’’

অমরজিৎ, সঞ্জীব, জ্যাকসনদের সঙ্গে নিয়মিত কথা হয় হরজিন্দরের। কী বলছে ছাত্ররা, কিছু করতে পারবে? ‘‘দেখুন, যাদের সঙ্গে খেলা পড়েছে, জেতা কঠিন। তবে ছাত্রদের যা মানসিকতা দেখছি তাতে হারার আগে ছাড়বে না কেউ।’’ বলার পর আশির দশকের জাতীয় দলের অপরিহার্য মিডিও-র মন্তব্য, ‘‘তিনটে খেলাই দেখব। আর চিৎকার করে উৎসাহ দেব। যে রকম দিতাম অ্যাকাডেমির হয়ে ম্যাচ খেলার সময়। ছাত্ররা বিশ্বকাপ খেলছে, আমি চেঁচাব না! হয় নাকি?’’ উত্তেজনায় গলা বুঁজে আসে তেষট্টি ছোঁয়া হরজিন্দরের।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement