শান্তিনিকেতনে ‘অরূপরতন’-এর মহড়া চলছে। রবীন্দ্রনাথ নিজে অভিনয় করবেন ঠাকুরদা আর অদৃশ্য রাজার ভূমিকায়। এ দিকে মহড়া চলতে চলতে তাঁর মনে হল, নাটকটির বেশ কিছু অংশে পরিবর্তন দরকার। অদলবদল করতে করতে এমন দাঁড়াল যে দ্বিতীয় সংস্করণ না বার করলে চলে না। ছ’-সাত বার প্রুফ দেখা হল। কবির সঙ্গে খেটে চলেছেন তাঁর পার্শ্বচর কর্মীও, নতুন করে লেখার ব্যাপারে তাঁর উৎসাহই যেন বেশি। শেষবেলায় কবি নির্দেশ দিলেন, এক দিনের মধ্যেই যেন নতুন সংস্করণ অন্তত আট-দশ কপি ছাপা হয়ে আসে, অভিনেতাদের হাতে হাতে নতুন সংস্করণ না থাকলে মহড়া এগোচ্ছে না।
সে দিন সন্ধ্যায় কোণার্কের বারান্দায় মহড়া বসেছে। নতুন বই হাতে পাওয়া যাবে না ধরে নিয়েই রবীন্দ্রনাথ বিরক্ত— “জানি, ছাপা হবে না বই— তবু বাহাদুরি! এখন কোথায় রইল সে... সব কাজ মাটি।” এ দিকে তখনই প্রেস থেকে নতুন বইয়ের কপি নিয়ে পৌঁছে গেছেন সেই কর্মী, গুরুদেবের মেজাজ গরম দেখে পিছন থেকে আস্তে আস্তে একটি বই ধরিয়ে দিলেন তাঁর হাতে। কবি ভাবলেন, পুরনো বইটাই দেওয়া হচ্ছে অগত্যা— “এটা কে চায়, এ দিয়ে কী করব?” বলতে বলতে দু’পাতা উল্টেই বুঝলেন, কর্মী কথা রেখেছেন। কোনও প্রশংসা বা উচ্ছ্বাসের ভাব কিন্তু ফুটল না মুখে, সঙ্গে সঙ্গে কলমটি তুলে নিয়ে বইতে কিছু একটা লিখে কর্মীকে কাছে ডাকলেন। কর্মী ভাবছেন, এত তাড়াহুড়োয় ছাপতে গিয়ে বোধহয় কিছু ভুল হয়ে গেছে! ভয়ে ভয়ে এগিয়ে এসে দেখলেন, নাট্যকারের নামটি কেটে, গুরুদেব লিখে দিয়েছেন— ‘শ্রীসুধীরচন্দ্র কর’। এই বার অপ্রস্তুত, বিমুগ্ধ কর্মীকে হেসে বললেন রবীন্দ্রনাথ— “তুমিই তো বলে বলে লেখালে, আবার ছাপিয়ে দিলে এরি মধ্যে। এ আমার নয়, তোমার।”
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ভাষায়, এই সুধীরচন্দ্র কর ছিলেন কবিগুরুর ‘খাস মুন্সী’। ১৯২৮ সালে কর্মসূত্রে শান্তিনিকেতনে আসেন সুধীরচন্দ্র, যোগ দেন গ্রন্থাগারের কাজে। ছ’মাস পরে সরাসরি কবির দফতরে কাজের ডাক এল। অবশ্য তার আগেই সুধীরবাবুর কবিতার খাতাটি দিনেন্দ্রনাথ দেখিয়েছিলেন তাঁকে। লেখালিখির পরিমার্জন, প্রুফ সংশোধন— এই সব ব্যাপারে সুধীরবাবুর নির্ভরযোগ্যতা হয়তো তখনই বুঝেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নিজের রচনা সম্বন্ধে তাঁর অসামান্য ‘বিস্মরণশক্তি’র কথা তিনি স্বীকার করেছেন বহু বার— গানের ক্ষেত্রে এ সমস্যার অনেকখানি সামাল দিতেন ‘ভাণ্ডারী’ দিনেন্দ্রনাথ, আর কবিতা বা অন্যান্য লেখা বাঁচিয়ে, গুছিয়ে রাখার কর্তা ছিলেন সুধীরচন্দ্র। তাঁকে নিয়েই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন একাধিক ছড়া-কবিতা— “লেখার যত আবর্জনা, জেনে রেখো সকলে/ সমস্ত রয় কর মশায়ের দখলে।” আবার পূর্ববঙ্গীয় জন্মভূমির সূত্রে ‘সুধীর বাঙাল’ নামেও সুপরিচিত তিনি— “সুধীর বাঙাল গেল কোথায়/ সুধীর বাঙাল কৈ/ সাতটা থেকে আমার মুখে/ নেই কথা এই বৈ।” এমনই ছিল সুধীরবাবুর উপর কবির নির্ভরতা। দাবি জানিয়ে তাঁর হাত থেকে নতুন লেখা বার করে নেওয়ার ব্যাপারেও তাঁর ‘বাঙাল’-সুলভ ‘জেদের অপ্রতিহত জোর’। ভাল হয়নি ভেবে প্রাথমিক ভাবে কবির ফেলে দেওয়া অনেক কবিতা রক্ষা পেয়েছে তাঁরই সৌজন্যে। ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় নন্দলাল বসুর লেখা ও স্কেচ প্রকাশ করার জন্য তাঁর সঙ্গেই যোগাযোগ করতেন সম্পাদকীয় বিভাগের কর্তাব্যক্তিরা, আবার ‘গুরুদেব’কে সব সময় সরাসরি না পাওয়া গেলে তাঁর বিষয়ে খোঁজখবর নিতে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বা রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সুধীরবাবুর দ্বারস্থ হতেন, এই সূত্রে প্রীতি-সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তাঁদের মধ্যেও। ‘প্রবাসী’র প্রতি সুধীরবাবুর যে বিশেষ পক্ষপাত ছিল, ইঙ্গিত দিয়েছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, গৌরবে বহুবচন ব্যবহার করে, “তোমরা তো আমার যা পাও, ঠেসে ভরো ‘প্রবাসী’তে। দাও দিয়ে এগুলোও।” এ ভাবেই ‘প্রবাসী’তে ছাপা হয়েছিল তাঁর শেষ বয়সের ছড়াগুলি। সুধীরচন্দ্র নিজেও ছিলেন সুলেখক, লিখেছেন বেশ কিছু কবিতা, নাটকও। তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকীর্তি অবশ্য ‘জনগণের রবীন্দ্রনাথ’ এবং গুরুদেবের সান্নিধ্য-স্মৃতিচারণে ভরপুর ‘কবি-কথা’। এ বইতে তিনি ‘একজন কর্মী’, ‘রচনা-রক্ষক’ ইত্যাদি অভিধায় নিজেকে ঢেকে রেখেছেন সবিনয়ে। কিন্তু শুধু এইটুকুতেই তাঁর পরিচয় সম্পূর্ণ হয় না। সুধীরচন্দ্র ছিলেন রীতিমতো সঙ্গীতরসিক, নিজেও গাইতেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা পূর্ববঙ্গের কুমিল্লায় একটি অনুষ্ঠানে, সেখানে গান গেয়েছিলেন সুধীরচন্দ্র— ‘এই লভিনু সঙ্গ তব, সুন্দর হে সুন্দর।’ সে ১৯২৬ সালের কথা। দু’বছর পরে শান্তিনিকেতনে এসে দফতরের কাজ সামলানোর পাশাপাশি দিনেন্দ্রনাথের কাছে সঙ্গীতচর্চাও অব্যাহত রেখেছিলেন তিনি। একাধিক বার নাট্যাভিনয়ে অংশ নিয়েছেন। কবির জীবদ্দশায় ‘নটীর পূজা’র শেষ অভিনয়ে চার বৌদ্ধ ভিক্ষুর অন্যতম ছিলেন সুধীরচন্দ্র, নিউ থিয়েটার্স-এর চলচ্চিত্রায়নেও এই নাটকে একই ভূমিকা তাঁর। ‘অরূপরতন’-এ পথিকদলের মধ্যে ছিলেন, ‘তাসের দেশ’ অভিনয়ের সময় প্রম্পটার-এর ভূমিকায়, আবার ‘নবীন’, ‘শাপমোচন’ ইত্যাদি গীতি-আলেখ্য-অভিনয়ে অংশ নিয়েছেন গায়ক হিসেবে।
সুধীরচন্দ্রের সঙ্গে সঙ্গীত ভবনের অধ্যক্ষ শৈলজারঞ্জন মজুমদারের সম্পর্ক ছিল বেশ অম্লমধুর। গানের সুরভেদ নিয়ে দু’জনের মধ্যে মৃদু চাপানউতোর যেমন চলত, তেমনই ‘রেষারেষি’ ছিল ‘গুরুদেব’-এর উপর কার দাবির জোর বেশি— এই নিয়ে। শৈলজারঞ্জনের স্মৃতিকথা ‘যাত্রাপথের আনন্দগান’-এ ধরা আছে সেই বিবরণ। ১৩৪৮ সনের বর্ষামঙ্গলকে কেন্দ্র করে নতুন ১৬টি গান লেখেন রবীন্দ্রনাথ। বেশির ভাগ রবীন্দ্রসঙ্গীত-রসিক জানেন, ক্লান্ত, প্রায়-অনিচ্ছুক কবিকে দিয়ে জোর করে এ সব গান লিখিয়ে নেওয়ার মূল উদ্যোক্তা ছিলেন শৈলজারঞ্জন। কিন্তু শৈলজারঞ্জন একা নন, তাঁর সঙ্গে মিলে রীতিমতো পরিকল্পনা-মাফিক এই গানগুলি আদায় করার কাজে আড়াল থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন ‘করমশায়’। ‘কবি-কথা’য় এর প্রসঙ্গ বিস্তারিত রয়েছে, তবে সে বইতে মাত্র কয়েকটি ক্ষেত্র ছাড়া নিজেকে প্রায় বিলুপ্ত রেখেছেন লেখক। এর ফলে বোঝা মুশকিল, বেহাগ-প্রিয় যে ‘উৎপাতকারী’র কথা রাখতে রবীন্দ্রনাথকে ‘আজি তোমায় আবার চাই শুনাবারে’ লিখতে হয়েছিল, কিংবা ‘গুরুদেবের গানে বাগেশ্রী বেশি নেই’ বলে ‘আড়ালে গবেষণা’ করে শৈলজাবাবুকে এগিয়ে দিয়েছিলেন যে মানুষটি— আর সে দাবি মেটাতেই জন্ম হয়েছিল ‘সঘন গহন রাত্রি’র— সেই মানুষটি আর কেউ নন, তিনি সুধীরচন্দ্র কর। রবীন্দ্র-স্বরলিপিকারদের তালিকায় দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অনাদিকুমার দস্তিদার, ইন্দিরা দেবী, শৈলজারঞ্জন মজুমদারের মতো মহাগুণীর পাশাপাশি কিন্তু সুধীরবাবুর নামটিও রয়েছে— বেশ কয়েকটি গানের স্বরলিপি তাঁর তৈরি।
‘গীতবিতান’-এর প্রথম সংস্করণ নির্মাণের সময় (১৯৩১-৩২) গান রচনার কাল ও গানের আদ্যক্ষর অনুযায়ী সূচি তৈরির নেপথ্য-কারিগর ছিলেন সুধীরচন্দ্রই। এত বড় কাজ নিখুঁত ভাবে করতে গেলে সময় লাগবেই, এ দিকে দেরি হলেও অধৈর্য হয়ে পড়তেন কবি, রাগের মাথায় প্রিয় সহকারীকে তিরস্কারও করেছেন চিঠিতে— “গীতবিতানের কোন অশুভগ্রহ তুমি?” কোনও গান খুঁজে না পেয়ে বিরক্ত হয়ে উঠলেও শেষ পর্যন্ত তা খুঁজে দিতেন সুধীরবাবু। রবীন্দ্র পরিচয়সভার অধিবেশনে দিনেন্দ্রনাথকে দিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত বিষয়ে বক্তৃতার আয়োজন করা থেকে শুরু করে জনগণের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের গান ছড়িয়ে দেওয়ার ভাবনা— সব কিছুতেই অগ্রণী ছিলেন এই মানুষটি। শান্তিনিকেতনের দফতরে নির্ধারিত কাজের পাশাপাশি গ্রামসেবা, পল্লিকল্যাণ ইত্যাদি কাজেও তাঁর উৎসাহ কম ছিল না। প্রথম যৌবনে আইন অমান্য আন্দোলনের সমর্থনে গ্রামে গ্রামে প্রচার করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছেন, আবার জেল থেকে বেরনোর পর সরকারের নজরে পড়ে যাওয়ার ভয় অগ্রাহ্য করে কবি তাঁকে ফিরিয়ে নিয়েছেন কাজে (‘রবিলিপিকর শ্রীসুধীরচন্দ্র কর’/সায়ন্তন মজুমদার)। এই মানুষটিকে ছাড়া যে তাঁর চলতই না। মাঝে মধ্যে অধৈর্য হয়ে একান্ত সহচরের উপর সামান্য কারণে বিরক্ত হয়েছেন ঠিকই— কিন্তু শুধু ‘কর্মী’ হিসেবে নয়, সুধীরবাবুর সাহিত্যপ্রতিভার স্বীকৃতিও তিনি দিয়েছেন বহু বার। তাঁর কবিতা অনুমোদন এবং প্রকাশের ব্যবস্থা করা, অন্যান্য বিশিষ্ট জনের লেখার সঙ্গে একই সঙ্কলনে তাঁর কবিতাকে স্থান দেওয়, এ সবে সমালোচনার অবকাশ থাকলেও গ্রাহ্য করেননি। সুধীরচন্দ্রের লেখা গদ্যকবিতার ভাব নিয়ে, কী ভাবে পদ্যে রূপান্তরিত করতে হয়, তা দেখিয়ে দিয়েছেন ‘প্রবাসী’র পাতায়, গুরু-শিষ্য দু’জনের কবিতাই ছাপা হয়েছিল এক সঙ্গে। সুধীরবাবুর কবিতাটির নাম ‘অভাবিত’— তার শেষ ক’টি পঙ্ক্তি — “যা ভাবি নি তাই—/ হোল এক মুহূর্তেই/ মন ভরে ডুবায়ে দিয়ে মন/ জাগছে শুধু একটিমাত্র শান্তমধুর/ ‘তুমি আছ’।” আর একে পদ্যে রূপান্তরিত করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন— “ডুবিল মন, ডুবিয়া গেল সকল বেদনা/ রয়েছে শুধু একটি চেতনা/ পূর্ণ করি আমার মনোভূমি/ একাকী আছ তুমি।” রবীন্দ্রনাথের কাছে এই ‘তুমি’ হয়তো তাঁর মানসী বা জীবনদেবতা, কিন্তু সুধীরবাবুর ‘তুমি’ তাঁর গুরুদেব স্বয়ং। আজীবন রবীন্দ্রময় এই অসাধারণ মানুষটি আজও অনেকাংশে রয়ে গেছেন রবীন্দ্র-ঘনিষ্ঠ অন্য অনেক গুণিজনের ঔজ্জ্বল্যের আড়ালে— কবির সান্নিধ্যের বেশি কিছু তাঁর হয়তো চাওয়ারও ছিল না।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।