প্রতিভাবান সঙ্গীতজ্ঞ দিলীপকুমার রায়। ফাইল চিত্র।
দু’টি নক্ষত্র যখন যার যার নিজস্ব কক্ষপথে আবর্তনে একে অপরের কাছাকাছি চলে আসে, তখন তাদের পারস্পরিক দীপ্তি বিনিময়ের একটা ইতিহাস তৈরি হয়। কখনও সে ইতিহাস আলোকিত করে সময়কে, কখনও বা এত দূরে হারিয়ে যায় যে আর চোখেই পড়ে না। সেই রকম দুই নক্ষত্রের এক জন মহাত্মা গান্ধী, অন্য জন নদিয়ার ভূমিপুত্র দিলীপকুমার রায়। নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের আদরের মন্টু। সেটা ১৯২৪ সালের কথা। অসুস্থতার জন্য মহাত্মা গান্ধী ভর্তি রয়েছেন পুণের এক হাসপাতালে। তাঁকে দেখতে এলেন দিলীপকুমার। কথা হল মহাত্মার সঙ্গে। সময় গড়ালে সাক্ষাৎ পরিচয়ের পরিধি ক্রমশ ছোট হয়ে এল উভয়ের কাছেই। আরও বেশি ঘনিষ্ঠ হলেন একে অপরের। সম্পর্কের সুতোয় নির্মিত হল ভিন্ন এক বলয়।
১৯৩৮ সালে গান্ধীজি যখন পেশোয়ারে, তখন দিলীপকুমার তাঁকে চিঠি লিখলেন ও কুশল সংবাদ নিলেন। অত্যন্ত খুশি হলেন মহাত্মা সে চিঠি পড়ে। তিনি দিলীপকুমার রায়কে পেশোয়ারে আমন্ত্রণ জানালেন টেলিগ্রাম করে। তারিখটা ছিল ১৯৩৮-এর ১৭ অক্টোবর। পেশোয়ারের কাছে উৎমানজই নামে একটি গ্রামে খান আবদুল গফফর খানের বাড়িতে তখন বিশ্রামে সময় কাটাচ্ছেন গান্ধী। তাঁর টেলিগ্রাম পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়লেন কৃষ্ণনগরের দিলীপকুমার। বিন্দুমাত্র কালক্ষেপ না করে সটান রওনা দিলেন কাশ্মীর থেকে পেশোয়ার। শ্রীনগর থেকে উৎমানজই গ্রাম, দীর্ঘ পাহাড়ি পথ পেরিয়ে যখন দিলীপকুমার এসে পৌঁছলেন গন্তব্যে, পথক্লান্তি নিমেষে মিলিয়ে গেল খান আবদুল গফফর খানের সহাস্য আন্তরিক অভ্যর্থনায়। গান্ধী তখনও স্নানঘর থেকে বেরোননি। দিলীপকুমারের আগমন-মুহূর্তটুকু যেন আবির্ভাব বলে মনে হল খান সাহেবের, মুখে চোখে তেজস্বিতার দীপ্তি, সুশ্রী, দীর্ঘকায়, বলিষ্ঠ, স্বল্পশ্মশ্রু— বর্ণে রাঙা আভার ছোপ। মুখে স্নিগ্ধ মৃদু হাসি। পলকেই খানসাহেবের মন কেড়ে নিলেন দিলীপকুমার।
মহাত্মাজি না আসা পর্যন্ত বাক্যালাপ চলল উভয়ের মধ্যে। দিলীপকুমার বিনম্র কৃষ্ণনাগরিক ভঙ্গিতে খান সাহেবকে বললেন, “খাঁ সাহেব, আপনার মতো এমন মানুষই তো আমাদের চাই— যাঁদের মধ্যে রয়েছে প্রেমের সঙ্গে সত্যের যোগ। আপনি মিল করে দিন হিন্দু-মুসলমানের। না হলে ভারতবর্ষের গতি কী হবে?” প্রশ্নটা শুনে খানিকটা নিশ্চুপ থেকে খানসাহেব বললেন, “আমি কী করব বলুন? মিল হয় তখনই যখন অন্তরে আসে নির্ভরতা— যখন মানুষ প্রেমের মন্ত্রকে দলের মন্ত্রের চাইতে বড় বলে মানে। ভিতরে প্রীতির ভিত পাকা না হলে বাইরের মিলনের ইমারত তো তাসের ঘর। হিন্দু-মুসলমান যত দিন না আচারগত ধর্মের চেয়ে অন্তরগত মৈত্রীকে বড় করে দেখবে তত দিন হতে পারে শুধু সুবিধের সন্ধি। সৌভ্রাতৃত্বের রাখিবন্ধন না।” কথাটার অপরিসীম গুরুত্ব উপলব্ধি করতে গিয়ে স্বাধীনতার পর সত্তর বছর কেটে গেল। আজও আমরা আচারগত ধর্ম আর অন্তরগত মৈত্রীর অর্থ উপলব্ধি করতে পারলাম কোথায়! সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিষয়টি নিয়ে কত দিন আগেও দিলীপকুমার রায় চিন্তা করেছিলেন। সঙ্গীতজগতের মানুষ হিসেবে তকমা দেগে দেওয়ার আগে তাই দিলীপকুমার রায়কে নিয়ে স্বতন্ত্র চর্চার অবকাশ অস্বীকার করা যায় না। দেশ নিয়ে নিজের মতো করে একান্তে ভাবছেন তিনি। সাম্প্রদায়িক বিষদাঁত উপড়ে ফেলার জন্য খনিত্র তুলে নিচ্ছেন সাহস করে।
স্নান সেরে ঘরে এলেন মহাত্মা। কিন্তু দিলীপকুমারের সঙ্গে তিনি তো কথা বলবেন না এখন। কারণ গত দু’মাস ধরে তাঁর মৌনব্রত চলছে। খানসাহেব হাতের কাছে এগিয়ে দিলেন কাগজ-কলম। গান্ধীজি লিখলেন, “মাই সাইলেন্স ইজ় গুড ফর মি, সার্টেনলি গুড ফর এভরিবডি এলস।” ঘরে আরও ক’জন বসে ছিলেন। মহাত্মার সেক্রেটারি ছিলেন সেখানে, তিনি কথাটা পড়ে শোনালেন সবাইকে। সে কথায় মজা পেলেন সকলেই। পরিবেশ হয়ে উঠল কৌতুকময়। ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠল দিলীপকুমারেরও।
সাক্ষাৎ কথাবার্তা সে ভাবে না হলেও গান্ধীজির সঙ্গে চিঠিপত্রে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন দিলীপকুমার। দীর্ঘ দশ বছর পর আবার এক বার দেখা হয়েছিল দু’জনের। এই সময়ে সঙ্গীতচর্চা নিয়ে ভীষণ ভাবে ব্যস্ত ছিলেন দিলীপকুমার। সে খবর অবশ্য মহাত্মাজির কাছে ছিল। তাই ১৯৪৭ সালের ২৯ অক্টোবর তিনি দিলীপকুমারের কাছে আবদার করলেন একখানা কবীরের ভজনগীত শোনাতে। আবদার রেখেছিলেন দিলীপ। দিল্লির সে প্রার্থনাসভায় স্বীয় মুনশিয়ানায় দিলীপকুমার যখন কবীরের ভজন গাইছেন, তখন আবেগে চোখ বুজে এল মহাত্মার। গান শেষ হতেই হাতে তুলে নিলেন মাইক্রোফোন, “তোমরা একটি মধুর ভজন শুনলে। কিন্তু যিনি ভজনটি গাইলেন তাঁর সম্বন্ধে তোমাদের কিছু জানা দরকার। তাঁর নাম দিলীপকুমার রায়।” এর পর সমবেত শ্রোতাদের সামনে দিলীপকুমারের সম্যক পরিচয় প্রসঙ্গে বললেন, “তেইশ বৎসর আগে যখন আমি পুণের হাসপাতালে ছিলাম তখন তিনি তাম্বুরার সঙ্গতে আমাকে দু’টি ভজন শুনিয়েছিলেন। সে গান দু’টি শুনে আমার শরীরের জ্বালা জুড়িয়েছিল। আজই সকালে তিনি আমার কাছে এসে দু’টি জাতীয় সঙ্গীত শুনিয়েছিলেন তাঁর নিজের দেওয়া সুরে, বন্দে মাতরম্ ও সারে জঁহাসে আচ্ছা।...” দিলীপকুমার রায়ের কণ্ঠে গীত এই দু’টি গানই মহাত্মার অত্যন্ত ভাল লেগেছিল। বিশেষ করে ‘বন্দে মাতরম্’ গানে দিলীপকুমারের করা সুর অভিভূত করেছিল তাঁকে। জাতীয় সঙ্গীতের পক্ষে এর চেয়ে উপযুক্ত আর কিছু হতেই পারে না, এমনটাই মনে করেছিলেন গান্ধীজি।
দিলীপকুমার রায় পাকাপাকি ভাবে চলে এলেন পুদুচেরিতে, শ্রীঅরবিন্দ আশ্রমে। কিন্তু গানের চর্চা থেকে কখনও নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেননি। আর তাঁর সেই সঙ্গীতসাধনার গুণমুগ্ধতা দিন দিন বেড়েই চলেছে গান্ধীজির অন্তরে। অকপটে বলেওছেন সে কথা, “গানের সমঝদার বলতে যা বোঝায় আমি তা নই। তবু আমি বেশ জোর করেই বলতে পারি তাঁর মতো কণ্ঠস্বর খুব কমই মেলে এ দেশে। শুধু এ দেশে কেন, সারা জগতেও এমন গভীর উদাত্ত ও মধুর কণ্ঠ বিরল।” দিলীপকুমার রায় সম্পর্কে এই মহান স্বীকৃতি সহজে মুছে যাওয়ার নয়।
শুধু কি মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে শরৎচন্দ্র, নজরুল ইসলাম, সুভাষচন্দ্র বসু, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, বুদ্ধদেব বসুর মতো একাধিক বুধসান্নিধ্য পেয়েছেন দিলীপকুমার। ঋষি অরবিন্দের সঙ্গে আত্মিক যোগ গড়ে উঠেছিল বলেই তো শেষ জীবনটা কাটিয়ে দিলেন আশ্রমিক হয়ে। শুধু ভারতীয় মনীষীরাই যে দিলীপকুমারের গুণমুগ্ধ ছিলেন তা নয়, বার্ট্রান্ড রাসেল থেকে শুরু করে রোম্যাঁ রল্যাঁ, সবাই ছিলেন দিলীপকুমার রায়ের গীতিমুগ্ধ শ্রোতা। দিলীপকুমার রায় ফরাসি ভাষা জানতেন বলে রোম্যাঁ রল্যাঁর সঙ্গে আলাপচারিতায় কখনও কুণ্ঠা বোধ করেননি। চিঠিপত্রও লিখতেন ফরাসি ভাষাতেই। ১৯২০ সালে এক বার সুইটজ়ারল্যান্ডের ‘শুনেকে’ গ্রামে রোম্যাঁ রল্যাঁর গ্রামের বাড়িতেও গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে রল্যাঁ পিয়ানো বাজিয়ে শোনান দিলীপকে। বাজানো শেষ হলে দিলীপকুমার গাইলেন ভারতীয় সঙ্গীত। গান শুনে রল্যাঁর মুগ্ধতার শেষ নেই। পরে চিঠিতে লিখেওছিলেন সে কথা, “যে সুন্দর গানগুলি তুমি আমার কাছে গেয়েছিলে তাতে আমি যেন আবার নতুন করে উপলব্ধি করেছিলাম যে, তোমাদের ও আমাদের সঙ্গীতের মধ্যে ব্যবধান কত কম। তোমরা যত বেশি মনে করো ততটা তো নয়ই।” এর পরেও বেশ কয়েকবার বিদেশের মাটিতে দিলীপকুমারের সঙ্গে রল্যাঁর সাক্ষাৎ ঘটেছিল। তবে তার বেশির ভাগটাই সুইটজ়ারল্যান্ডে। প্রতি বার দিলীপের কণ্ঠে গান শুনেছেন আর মুগ্ধতা সঞ্চিত হয়েছে হৃদয়ে, “আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তোমাদের সঙ্গীত থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। প্যারিসের কয়েকটি বিখ্যাত সঙ্গীতপত্রিকায় কেন তুমি তোমাদের রাগসঙ্গীত সম্বন্ধে স্বরলিপি, প্রবন্ধ, ব্যাখ্যা প্রকাশ করছ না?” এই মহৎ প্রেরণা অভিভূত করেছিল দিলীপকুমারকে। কৃতজ্ঞতায় জোড়হাত করে তিনি উত্তরে বললেন, “মসিয়েঁ রল্যা, আমি এত দিন ইউরোপে আমাদের গানের সওদা করবার কোনও সত্য প্রেরণাই অনুভব করিনি। কারণ আমার বিশ্বাস ছিল যে ইউরোপ কখনওই আমাদের সঙ্গীতের ধারাটি ঠিকমতো গ্রহণ করতে পারবে না।” রোম্যাঁ রল্যাঁর মতো এমন বিশ্ববিশ্রুত পণ্ডিত ও সঙ্গীতজ্ঞের মুখে এই কথা শুনে নিজের পুরনো ধারণা পাল্টে ফেলেছিলেন দিলীপকুমার।
শুধু রল্যাঁর সঙ্গে আন্তরিক আলাপচারিতাই নয়, দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের সঙ্গেও দিলীপকুমারের ছিল অকৃত্রিম সৌহার্দের সম্পর্ক। ১৯২২-এর অগস্টে সুইটজ়ারল্যান্ডের লুগানো শহরে একটি বক্তৃতাসভায় রাসেলের সঙ্গে দিলীপকুমারের প্রথম আলাপ, পরে ঘনিষ্ঠতা। রাসেলের বক্তৃতা শুনে মুগ্ধ হন দিলীপ, বিশেষত তাঁর শাণিত বিদ্রুপের আলো কী ভাবে বক্তব্যকে ধারালো করে তুলতে পারে, তা শুনে। পরে লিখেছিলেন, “রাসেলকে আমরা আরও শ্রদ্ধা করেছিলাম তাঁর চরিত্রে একটি আশ্চর্য স্বতোবিরোধ ছিল বলে। এর নাম মিস্টিসিজম।” অন্য দিকে দিলীপকুমার রায়ের প্রতিও বার্ট্রান্ড রাসেলের ভালবাসা ছিল গভীর, “সব দিক থেকে দেখে আমার মনে হয় যে আমি যদি তুমি হতাম তবে আমি সঙ্গীতেই আমার জীবন নিয়োগ করতাম। রাষ্ট্র নিয়ে কেবল ততটুকু কালক্ষেপ করতাম যতটুকু সঙ্গীতচর্চার পরেও সম্ভব।” ১৯২২ সালের পর দিলীপকুমার রায় ভারতে ফিরে এলেও রাসেলের সঙ্গে চিঠিপত্রে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন।
কিন্তু আজও ইতিহাসের পাতায় খুব বেশি পৃষ্ঠা ব্যয়িত হয় না দিলীপকুমার রায়ের জন্য। অথচ প্রতিভাধর এই মানুষটি ১৯৫৩ সালে ভারতের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি হয়ে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়েছেন। তাঁকে এই বিশেষ কাজে পাঠানোর মূল উদ্যোগ করেছিলেন জওহরলাল নেহরু ও আবুল কালাম আজাদ। ভারতীয় প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব নিয়ে তিনি পৃথিবীর একাধিক দেশে ভারতের শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর নিজস্ব ভাবনার কথা, দেশের গরিমার কথা প্রচার করে এসেছিলেন। এ দেশের ধারাবাহিক ইতিহাস ও শিল্পসাহিত্যের চর্চায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে দিলীপকুমার রায়ের সেই বিপুল অবদানের কথা। উদাসীন বিস্মৃতির এই ‘অপরাধ’ থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা ভাবের ঘরে চুরি ছাড়া কিছু নয়।