আজ সাক্ষাৎকার দিলেন: বঙ্গারু লক্ষ্মণ

উফ দিদি, বড্ড লেগেছে?

আজ সাক্ষাৎকার দিলেন: বঙ্গারু লক্ষ্মণ

Advertisement

শান্তনু চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০১৬ ০০:০৩
Share:

বঙ্গারু লক্ষ্মণ, এখন যেমন। ফোটোগ্রাফারের হাত ভয়ে নড়ে যাওয়ায়, ছবিটা কেঁপে গেছে।

প্রতিবেদক: আরে, আপনার মুখটা একটু হাসি-হাসি মনে হচ্ছে যে! এনডিএ কিংবা বিজেপি-র প্রেস কনফারেন্সে তো বরাবর কী রকম একটা নিমের পাঁচন খাওয়া, গোমড়া মুখই দেখে এসেছি। তা, এ হাসির পেছনে কোথাও ‘নারদ’ বাবাজির হাত আছে নাকি?

Advertisement

বঙ্গারু লক্ষ্মণ: আরে শুধু আমি হাসছি নাকি? খোঁজ নিয়ে দ্যাখো, দিল্লির এ-পাড়া ও-পাড়া, ও-বাংলো সে-বাংলোয় আরও কত্ত লোক হেসে হেসে খুন হচ্ছে। জয়াজি, মানে জয়া জেটলি তো এক দিনে এত হেসেছেন, ওঁর নাকি সুগার অবধি কমে গেছে! এমনকী যে ফার্নান্ডেজ সাহেব এখন খাইয়ে দিলে খান, শুইয়ে দিলে শোন, প্রায় কোনও কথাই বুঝতে পারেন না— খবরটা শোনানোর পরে, তাঁর চোখেমুখেও নাকি কী একটা ভাব খেলে গেছে। জয়া জেটলি যার মানে করেছেন— দ্যাখ্ কেমন লাগে!

প্রতি: জর্জ ফার্নান্ডেজের মুখ দেখিনি অনেক কাল। কিন্তু আপনার সারা মুখে তো রীতিমত হিংস্র সেডিস্ট আনন্দ উপচোচ্ছে! বাংলার ‘দিদি’র গায়ে স্টিং অপারেশনের হুল ফুটল কি ফুটল না, আপনি আহ্লাদে একেবারে আট-বারো-ষোলোখানা হচ্ছেন কেন?

Advertisement

বঙ্গারু: হব না? সে বারে উনি কী নাটকটাই না করলেন! আমার ঘরে তহেলকা ঢুকেছে তো গোটা এনডিএ-র যেন জাত গেছে। আর আমার সেই ‘পতিত’ হওয়া নাকি এমনই জল-অচল ব্যাপার যে দিদি হাঁড়ি আলাদা করেও নিজের সৎ সংসার সচল রাখতে পারবেন না। তাই এনডিএ-পরিবারটাই ছেড়ে দিলেন। সব পার্টিই যেমন বলে, আমরাও বলে দিলাম— ভিডিয়োটা ভুয়ো, ফুটেজ’টা জুয়ো মানে জুয়োচুরি, অপারেশনটা চক্রান্ত, চক্রান্তটা রাজনৈতিক, রাজনীতিটা নোংরা, আর আমরা তার শিকার! তবে সঙ্গে ফাউ, ইস্তফাটাও কিন্তু দিয়েছিলাম। দিদিকে বলাও হয়েছিল, দু-চারটে দিন একটু দেখে যান। কিন্তু উনি তো তখন বিবেকের অম্বলে আইঢাই করছেন। ‘আমি কী সৎ’-‘আমি কী সৎ’— ঢেকুর তুলতে তুলতে মূল্যবোধের হাওয়াই চটি ফটফটিয়ে উনি ‘চোরেদের ক্যাবিনেট’ ছেড়ে কংগ্রেসি নাওয়ে গিয়ে উঠলেন।

প্রতি: তা হলে এটাকে বিবেকের চোঁয়া ঢেকুর বলছেন কেন, এ তো ভেবেচিন্তে নেওয়া রাজনৈতিক চাল?

বঙ্গারু: সেটা হয়তো খানিকটা ঠিক। কিন্তু তখনকার মমতাদিদি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় থাকলেও আসলে আগাপাছতলা বিরোধী নেত্রী! তিনি ক্ষমতা চান, কিন্তু ক্ষমতার সঙ্গে তাঁর ফুলটু আদায়-কাঁচকলা! তিনি শেষ অবধি আপসেই যাবেন, কিন্তু আপসের সঙ্গে তাঁর তখন অবধি আপসহীন সংগ্রাম! মমতাদির কাছে দুর্নীতির ইস্যু তখনও রাস্তায় আচমকা গাড়ির চাকায় ছিটকোনো কুটকুটে পাঁক। কোনও রকমে গায়ে লেগে গেলে তক্ষুনি তক্ষুনি বাড়ি ফিরে জামা-কাপড় ধুয়ে-কেচে হাতে-পায়ে সাবান ঘষে সাফসুতরো হতে হয়! নইলে বাংলা-বাজারে তাঁতের শাড়ি-হাওয়াই চটির ব্র্যান্ডভ্যালু কমে যাবে। তখনকার দিদি তাই দুর্নীতির ধুয়ো দেখলেই দমকল-ফমকল ডেকে একশা করতেন। আজ তিনি নিজেই যখন ক্ষমতার গদিতে গড়াগড়ি, আর তাঁর তৃণমূল পার্টিও রাজধানীর আরও অনেকেরই ভাই-ভাতিজা— তখন ‘সারদা’ই বলো আর ‘নারদা’— দিদি আমাদের এখন সুপার-কুল!

প্রতি: তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, ওঁর সংঘর্ষের রাজনীতি এখন পুরোদস্তুর চেয়ারের ক্ষমতার মানে বুঝতে শিখে গেছে? ঘরের ভেতর, ঘাড়ের পাশে দুর্নীতির বাঘ দেখলেও আগের মতো ঘাবড়ে-টাবড়ে লাফ-ঝাঁপ করছেন না?

বঙ্গারু: আরে সেটা তো যেচে বাঁশ নেওয়া হবে। দিদি সারদাতেই সার বুঝেছেন, আম-পাবলিক ও সব দুর্নীতি-টুর্নীতি নিয়ে থোড়াই মাথা ঘামায়! এ দেশের মানুষ জন্ম ইস্তক জানে, কিছু পেতে হলে, কিছু মালকড়ি ছাড়তে হয়। সারদা-মালিকের নিজের গাদা গাদা ঘাপলা ছিল, দিদির পার্টির লোকেরা পালটা তাদের দুয়ে নিয়েছে আচ্ছা করে! এটা এক রকমের সমাজসেবাই! যে অনেক কামাচ্ছে, তাকে নেতার কাছে, কিংবা পার্টির কাছে, অন্তত পার্টির বলে দেওয়া সিন্ডিকেটের কাছে, নজরানা তো দিতেই হয়! নইলে সেই লোকটাই তো খামকা আঙুল ফুলে কলাগাছ হবে। হাত-ফাত নড়াতে পারবে না। যাকে বলে ঘোর কেলো! সেখানে মমতাদিদির দলের তরফে কলাগাছের বাড়বাড়ন্ত যদি একটু ‘সাইজ’ করেই নেওয়া হয়, সেটাকে তো ‘তৃণমূল’ স্তরে মেডিকাল পরিষেবা হিসেবেই দেখা উচিত। ক্ষমতার মমতা বাংলার দিকে দিকে এই পরিষেবা চালু করে দিতে পেরেছেন। আসলে দুর্নীতি দেখার পুরনো বিরোধী চশমাটাই দিদি এখন পালটে ফেলেছেন। শাসকের নতুন চশমায় দুর্নীতি দেখলে আর লড়াই-খ্যাপা দন কিহোতে বা পাগলা জগাইয়ের মতো ছুটে গিয়ে ঢুঁশ মারতে ইচ্ছে করে না। বরং কত নতুন নতুন ‘ক্রিয়েটিভ’ ঝুলবারান্দা, ছাদ, উঠোন, আলসে, কারনিস চোখে পড়ে! সেখানে এমনি জনগণ থেকে শুরু করে ভোটের টিকিট-সিন্ডিকেটের দালালি— কালীঘাটের ক্লাসঘরে ফার্স্টবেঞ্চে বসতে না পাওয়া বিক্ষুব্ধ প্রার্থী— তেড়িয়া জঙ্গি কর্মী-অভিমানী নেতা, সব্বাইকে জায়গা করে দেওয়া যায়!

প্রতি: কিন্তু দুর্নীতির এই চমৎকার গোছানো, স্বাস্থ্যকর, মিষ্টি ভালবাসার রাজপ্রাসাদে কোত্থেকে স্টিং অপারেশনের হুল বাগানো বোলতারা ঢুকে পড়ে?

বঙ্গারু: হ্যাঁ, এরা বুঝতেই চায় না, দুর্নীতি আসলে ‘সব হাতে কাজ’, ‘সব মাথায় ছাদ’ জোগানোরই একটা আশ্চর্য বিকল্প বন্দোবস্ত! মাঝখান থেকে দিব্যি চালু এক-একটা প্রোজেক্ট বেকার ঘেঁটে দেয়! তা ছাড়া এই সব স্টিং-ফিং করে কী প্রমাণ হয় বলো তো! আমার হাতে থোক এক কাঁড়ি টাকা গুঁজে দেওয়া মানেই কি আমি রোজ রোজ ঘুষ খাই? তুমি এমনিতে অন্য মেয়েমানুষের দিকে চোখ তুলে চাওই না! তো মিনিস্কার্ট পরে সটান তোমার চেম্বারে ঢুকে কোল ঘেঁষে থেবড়ে বসে, হালকা হাস্কি গলায় ফিসফিসিয়ে বলল— ‘আদর করো’। আর তুমি একটু করলেও! তাতেই কি প্রমাণ হয় তুমি চরিত্রহীন?

প্রতি: কিন্তু ২০০১-এ তো দেশসুদ্ধ লোক বিশ্বাস করেছিল আপনি ঘুষ খান? ‘নারদা’ হয়তো দিদির পোক্ত-ফলাও বন্দোবস্তকে নড়াতেই পারবে না। কিন্তু ‘অপারেশন ওয়েস্ট এন্ড’ তো বুড়ো বয়সে আপনাকে গারদে ঢুকিয়ে ছেড়েছিল?

বঙ্গারু: ওটাই তো মুশকিল! সব দুর্নীতি এক নয়। তুমি কাপড়কলের মালিক বা শেয়ার বাজারের দালালের কাছ থেকে ঘুষ খেলে লোকে গায়ে মাখবে না। এই যে কোটির পরে কত কত শূন্য বসাল ‘টুজি’-র মেগাকেলেঙ্কারি— লোকে ‘এ জি, ও জি, লো জি, সুনো জি’ বলতে বলতে সেটাও প্রায় ভুলে গেল! কিন্তু যখনই স্ক্যাম’টায় অস্ত্রশস্ত্র, মিলিটারি, নিরাপত্তা— এ সব জড়িয়ে যাবে, অমনি লোকের দেশভক্তির নাড়ি টনটন করে উঠবে! টাকা খেয়ে সীমান্তের সৈন্যদের জন্য আজেবাজে অস্ত্র কিনছ? কারগিল-শহিদদের কফিন কিনতেও কাটমানি? তোমার কলঙ্কের দাগ কয়লা-কেলেঙ্কারির চেয়েও বেশি কালো! পচে মর ব্যাটা জেলে! তাই ঘুষ খাওয়াটাও নাগপুরের স্লো-টার্নার ভাগাড়ে ব্যাটিং-এর মতো। মারার বলটা মারো! কিন্তু ছাড়ার বলটা ছাড়তে না পারলেই তুমি হড়কালে— ৭৯ অল আউট!

sanajkol@gmail.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement