বিশ্বকাপের দলে তাঁর থাকারই কথা নয়। যশপ্রীত বুমরার চোট তাঁকে দলে ফিরিয়ে আনে। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সোমবারের ম্যাচে ১৯ ওভার পর্যন্ত তাঁকে বল করতেও দেখা যায়নি। শেষ ওভারে যখন ১১ রান বাকি তখন তিনি এলেন, ৩টি উইকেট নিলেন এবং ভারতকে ম্যাচ জেতালেন। মহম্মদ শামি যেন ফিরলেন ফিনিক্সের মতো।
গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর থেকে শামি ভারতীয় দলের হয়ে কুড়ি ওভারের ক্রিকেট খেলেননি। করোনা আক্রান্ত হওয়ার কারণে অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে টি-টোয়েন্টি সিরিজ়ে খেলতে পারেননি তিনি। এ বারের বিশ্বকাপেও তাঁর জায়গা হত না। বুমরা চোট পাওয়ায় যেন পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতো সুযোগ পেয়েছেন। বাংলার জোরে বোলার প্রস্তুতি ম্যাচের একটি ওভারেই বুঝিয়ে দিলেন, সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করবেন।
বস্তুত, শুধু ক্রিকেটের মাঠে নয়, শামির ব্যক্তিগত জীবনেও টানাপড়েন চলেছে বিস্তর। স্ত্রী হাসিন জাহানের সঙ্গে তাঁর বিবাহবিচ্ছেদের মামলা চলছে দীর্ঘ দিন ধরে। হাসিনকে নিয়ে একাধিক বার বিতর্কে জড়িয়েছেন বাংলার জোরে বোলার।
২০১৭ সালে কলকাতার মডেল হাসিনের সঙ্গে বিয়ে হয় শামির। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে তাঁর বিরুদ্ধে প্রথম এফআইআর দায়ের করেন হাসিন। স্বামীর বিরুদ্ধে গার্হস্থ্য হিংসার অভিযোগ নিয়ে থানায় যান তিনি।
শামির পাশাপাশি হাসিনের নিশানায় ছিলেন তাঁর পরিবারের সদস্যরাও। শামির দাদার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়েছিল। এ ছাড়া, স্বামীর বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার অভিযোগও এনেছিলেন হাসিন।
স্ত্রীর সমস্ত অভিযোগ উড়িয়ে দেন শামি। তাঁর পাল্টা দাবি ছিল, ক্রিকেট থেকে তাঁকে সরিয়ে দিতে, তাঁর কেরিয়ার নষ্ট করতে পরিকল্পনামাফিক এই চক্রান্ত করা হয়েছে। হাসিন-বিতর্কে খবরের শিরোনামে উঠে এসেছিলেন জোরে বোলার। বাইশ গজেও তার প্রভাব পড়েছিল।
শামির বিরুদ্ধে ম্যাচ গড়াপেটার অভিযোগও এনেছিলেন স্ত্রী হাসিন। কিন্তু ভারতীয় বোর্ড তদন্তের পর তাঁকে ক্লিনচিট দিয়েছে। তার পর থেকে বাইশ গজকেই পাখির চোখ করেছেন বাংলার এই জোরে বোলার।
বিতর্কিত এই জোরে বোলারের সঙ্গে প্রথমে জাতীয় দলের চুক্তি বাতিল করে দিয়েছিল ভারতীয় বোর্ড। পরে নতুন করে চুক্তি করা হয়।
শামি আর হাসিনের একমাত্র কন্যা আইরা। স্ত্রীর সঙ্গে বিবাদের ফলে মেয়ের থেকে দূরে থাকতে হয় শামিকে। সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে একাধিক বার মেয়ের প্রসঙ্গ উঠতেই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন তিনি। মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে মন কেমন করে, নিজেই জানিয়েছেন সে কথা।
ব্যক্তিগত জীবনের টানাপড়েন তো আছেই, ক্রিকেটের জন্যেও বার বার ধাক্কা খেয়েছেন ভারতীয় জোরে বোলার। ২০২১ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতীয় দলে তিনিই ছিলেন একমাত্র মুসলমান সদস্য। ধর্মের কারণে তাঁকে নানা কটাক্ষের সম্মুখীন হতে হয়েছিল।
পাকিস্তানের কাছে সে বার হেরে গিয়েছিল ভারত। মহম্মদ শামি অনেক রানও দিয়েছিলেন। সমাজমাধ্যমে তাঁকে কার্যত তুলোধনা করেছিলেন ভারতের সমর্থকরা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সে সব কটাক্ষে ছিল সাম্প্রদায়িক ইঙ্গিত।
সে সময় অবশ্য দলের সতীর্থদের পাশে পেয়েছিলেন শামি। বিরাট কোহলি তাঁকে সমর্থন করে সমালোচকদের নিন্দা করেন প্রকাশ্যেই। অন্যান্যরাও শামির সমর্থনে মুখ খুলেছিলেন।
বিশ্বকাপে ব্যর্থতা, অসুস্থতা, ব্যক্তিগত জীবনের টানাপড়েন— সব মিলিয়ে ক্রিকেট থেকে যেন ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছিলেন শামি। আইপিএলে গুজরাত টাইটান্সের হয়ে বল হাতে নজর কেড়েছিলেন। তবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ১৫ জনের দলে প্রথমেই তাঁর জায়গা হয়নি।
সম্প্রতি চোটের কারণে বুমরা দল থেকে ছিটকে গেলে শামির পাশাপাশি মহম্মদ সিরাজ, শার্দূল ঠাকুরদের নামও উঠে আসছিল। শেষমেশ শামির অভিজ্ঞতার উপরেই ভরসা রেখেছেন নির্বাচকরা।
বাইশ গজে বল হাতে শামির উত্থান-পতন লেগেই থাকে। আসন্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তাঁর কাঁধে ভর করে সোমবার জয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করল ভারত। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে বিশ্বকাপের প্রস্তুতি ম্যাচে মাত্র এক ওভারেই জ্বলে উঠে শামি নিজের জাত চেনালেন। যেন বিতর্ক, সমালোচনার ছাই থেকে মাথা তুলল রূপকথার ফিনিক্স।