ইলন মাস্কের হাতে চলে গেলে টুইটারের ভবিষ্যৎ ‘অন্ধকার’। সোমবার টুইটারের কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করার সময়ে নাকি এমনই আশঙ্কা প্রকাশ করেন টুইটারের সিইও পরাগ অগ্রবাল, বলে জানিয়েছে সংবাদ সংস্থা রয়টার্স। কিন্তু কেন এমন বললেন পরাগ? কারণ রয়েছে একাধিক। বিতর্ক যেন পিছুই ছা়ড়তে চায় না আমেরিকান ধনকুবেরের।
মাস্ক যখন টুইটার কেনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন তখনই জানিয়ে দিয়েছিলেন, প্রস্তাব গৃহীত না হলে তিনি নিজের অংশীদারিত্ব আর রাখবেন কি না, তা-ও পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হবেন। মাস্কের দাবি, তিনি টুইটারের অংশীদার হওয়ার সময়ে ভেবেছিলেন টুইটার বিশ্বজুড়ে বাক স্বাধীনতার মূল মাধ্যম হয়ে উঠবে। কিন্তু বিনিয়োগ করার পরই নাকি তিনি উপলব্ধি করছেন যে, বর্তমান অবস্থায় তা কখনওই সম্ভব নয় টুইটারের পক্ষে। তাই ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সংস্থা হিসাবে এর বদল ঘটানোই তাঁর লক্ষ্য। কিন্তু এই ‘বাক স্বাধীনতা’ টুইটারকে কতটা বদলে দিতে পারে, তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে বিশ্ববাজারে।
ইলন মাস্ক নিজে টুইট করে জানিয়েছেন, বাক স্বাধীনতা থাকলে তিনি আশা করছেন, তাঁর সবচেয়ে বড় সমালোচকও টুইটারে দিব্যি থাকতে পারবেন। এ কথায় অনেকে যেমন চটেছেন, তেমন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির অনুরাগীরা খুশিও হয়েছেন। প্রথম দল মনে করছে, এতে টুইটারে বিভিন্ন কনস্পিরেসি থিয়োরিস্ট, নাৎজি, হেনস্থাকারী, এবং উগ্র পুরুষতান্ত্রিকে ভরে যাবে। কোনও ভদ্রলোক এখানে আর টিকতে পারবেন না। এ দিকে অন্য দল মনে করছে, মাস্ক যেটা করছেন, সেটাই ঠিক। বাক স্বাধীনতা সকলের অধিকার। আমেরিকাও তাই-ই শেখায়।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে টুইটার অনেক অতিদক্ষিণপন্থীদের অ্যাকাউন্ট নিষিদ্ধ করে দিয়েছেল। ট্রাম্পও সে দলে পড়েন। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ইউএস ক্যাপিটল আক্রমণের পর ট্রাম্পের অ্যাকাউন্ট চিরকালের জন্য নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল টুইটার। ইলন মাস্কের হাতে টুইটারে মালিকানা যাওয়ার পর অনেকেই মনে করছেন, এঁরা ফের টুইটার ব্যবহার করতে পারবেন। ট্রাম্প ফিরবেন কি না সেই নিয়েও জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে। ট্রাম্প অবশ্য সংবাদমাধ্যমকে জানিয়ে দিয়েছে, তিনি ইলন মাস্ককে খুব পছন্দ করলেও টুইটারে ফিরবেন না।
প্রসঙ্গত, ইলন মাস্ক নিজেও বহু বার বহু বিতর্কিত টুইট করেছেন। মাঝেমাঝেই টুইটারে তাঁকে কোনও না কোনও তর্কে জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। তবে টুইটার এবং বাস্তব দুনিয়াতেও তাঁর নিজস্ব অনুরাগীদের সংখ্যা কম নয়। অনেকটা ‘কাল্ট’-এর মতোই তাঁরা মাস্ককে পুজো করে বলা যেতে পারে। সেই দলে রয়েছে আমজনতা থেকে তেলের সম্রাটরাও! টুইটের জন্য এক বার মানহানির মামলাও করা হয় মাস্কের বিরুদ্ধে। আমেরিকার এসইসি এক বার তাঁকে টেসলার কোনও খবর নিয়ে টুইট করায় নিষেধাজ্ঞাও জারি করে। কিন্তু তাতে দমে যাননি মাস্ক। তাঁর ৮ কোটি ৬৫ লক্ষ টুইটার অনুরাগীর জন্য তিনি টুইট করেই যেতেন।
২০১৮ সালে টেসলার মডেল ৩ গাড়ির উৎপাদন নিয়ে নানা রকম ঝামেলার সম্মুখীন হতে হয় মাস্ককে। তা নিয়ে ক্রমাগত সংবাদমাধ্যমে লেখালিখি চলতে থাকে। তাতে চটে গিয়ে টুইট করে মাস্ক সাংবাদিকদের উপর তাঁর সমস্ত রাগ উগরে দেন। তিনি এমনও বলেন যে, একটি ওয়েবসাইট খুলবেন তিনি, যাতে প্রত্যেক সাংবাদিককে নম্বর দেওয়া হবে। ওয়েবসাইটের নামও ঠিক করে ফেলেন তিনি, ‘প্রাভদা’ (এই নামে সোভিয়েট ইউনিয়নে এক কুখ্যাত সংবাদপত্র ছিল)। মাস্কের এই টুইটের সমালোচনা করেছিল সমগ্র সংবাদমাধ্যম। কিন্তু তাঁর অনুরাগীরা এই ভাবনাকে সাধুবাদ জানিয়েছিল।
মাস্ক ২০১২ সালের ৭ অগস্ট টুইট করে জানান, তিনি টেসলার সব শেয়ার কিনে ফেলার জন্য ১০০০ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি অর্থ জোগাড় করে ফেলেছেন। টেসলার সব ফ্রি-ফ্লোটিং স্টক কিনে ফেলতে চান তিনি। পরে অবশ্য এক সাক্ষাৎকারে তিনি স্বীকার করেন, গাঁজার খেয়ে এই টুইট করে ফেলেছিলেন তিনি।
২৪ অগস্ট তিনি এক বিবৃতি দিয়ে জানান, সংস্থার অংশীদারদের সঙ্গে আলোচনা পর তিনি ঠিক করেছেন, সংস্থা যেমন আছে। তেমন থাকাই ভাল। তিনি কোনও শেয়ার কিনছেন না। তবে এই বিবৃতি দেওয়ার আগে তাঁকে ২ কোটি মার্কিন ডলার জরিমানা দিতে হয় এসইসি-কে। টেসলা নিয়ে আর কোনও টুইট করা নিষিদ্ধ হয়ে যায় তাঁর।
২০১৮ সালে তাইল্যান্ডে শিশুদের একটি ফুটবল টিম জলে ডোবা গুহায় আটকে গিয়েছিল। মাস্ক আবার মার্ভেলের টনি স্টার্কের সঙ্গে নিজের মিল খুঁজে পান। তাই তিনি এক সাবমেরিন পাঠানোর প্রস্তাব দেন শিশুদের উদ্ধার করতে। কিন্তু ব্রিটিশ ডাইভার ভার্নন আনসওয়ার্থের সেটা শেষ পর্যন্ত প্রয়োজন পড়েনি।
তাতে বেজায় চটে যান মাস্ক। রেগে এক সাক্ষাৎকারে আনসওয়ার্থকে ‘শিশু ধর্ষক’ বলে বসেন তিনি। পরে অবশ্য স্বীকার করেন যে, রাগের মাথায় এমন অসত্য বলে ফেলেন তিনি। তা নিয়ে এত হইচই করার কী আছে!
২০১৮ সালে সব বিতর্ক পেরিয়ে এক পডকাস্টে উপস্থিত হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেখানেও লাইভ স্ট্রিমিংয়ের সময়ে হুইস্কি পান করেন এবং গাঁজাও টানেন মাস্ক। খাওয়ার আগে অবশ্য জেনে নেন ক্যালিফোর্নিয়ায় তা আইনত বৈধ কি না।
বিষয়টি ভাল চোখে দেখেনি নাসা বা আমেরিকার বায়ুসেনা। নাসা জানায়, এ ঘটনার পর তাঁরা মাস্কের স্পেসএক্স-এর নিরাপত্তার উপর বিশেষ নজর দেবে।
কোনও সংস্থার সিইও কি জনসম্মুখে মেনে নেবেন, যে সংস্থার শেয়ারের দাম অতিরিক্ত চড়া! তবে মাস্ক আবার যে সে সিইও নন। তাই তিনি ২০২০ সালে কয়েকটি শব্দ শুধু টুইট করেন, ‘টেসলা স্টক প্রাইস ইজ টু হাই আইএমও’। তাতেই টেসলার বাজার দর ৯ শতাংশ পড়ে যায় ঝপ করে। মাস্কের ব্যক্তিগত সম্পত্তির দরও ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার পড়ে যায়!
২০২০ সালে কোভিডের লকডাউনে ক্ষেপে গিয়ে মাস্ক টুইট করেন, ‘ফ্রি আমেরিকা নাও’। এতেও সমালোচনার ঝড় উঠেছিল সব মহলেই।
২০১৯ সালে মাস্কের বিতর্কিত টুইট ‘নিউক মার্স’। কেন মঙ্গলগ্রহে হঠাৎ পরমাণু হামলা করতে বলছেন মাস্ক, সে প্রশ্ন উঠেছিল তখনই। শিশুমন যেমন নানা রকম খেলায় মেতে ওঠে, তিনিও বোধ হয় তেমনই। পরমাণু হামলায় মঙ্গল গ্রহের তাপমাত্রা বাড়লে, তা বাসযোগ্য করা যাবে বলে ভেবেছিলেন তিনি।