ক’দিন আগে পর্যন্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি বই পড়ছিলেন। যে বিষয়ে তাঁর বরাবরের আগ্রহ। কিন্তু সেই বইটি আপাতত পাশে সরিয়ে রেখে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় ইদানীং হাতে তুলে নিয়েছেন রডনি ব্রেজিয়ারের লেখা ‘কনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস’-এর দ্বিতীয় সংস্করণ! সেই সঙ্গে ব্রিটিশ ও ভারতীয় সাংবিধানিক ব্যবস্থা সংক্রান্ত আরও কিছু বই। কেন? রাইসিনা হিলস্-সূত্র বলছে, ১৬ মে লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশ নিয়ে যখন কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গিয়েছে, তখন পরবর্তী সরকার গঠনের জন্য ‘হোমওয়ার্ক’ সেরে রাখছেন প্রণববাবু।
রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের কর্তাদের মতে, কোনও একটি রাজনৈতিক দল বা প্রাক্-ভোট জোট স্পষ্ট জনাদেশ পেলে সরকার গঠন নিয়ে কোনও জটিলতা থাকবে না। গত কাল শেষ দফা ভোটের পরে বিভিন্ন বুথ-ফেরত সমীক্ষায় ইঙ্গিত, বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে চলেছে। এই ইঙ্গিত মিলে গেলে রাষ্ট্রপতির কাজ সহজ হয়ে যাবে। কিন্তু সেই ফল যদি না মেলে? কোনও দল বা প্রাক্-ভোট জোট যদি স্পষ্ট জনাদেশ না পায়? সমস্যা হবে সেখানেই। রাইসিনা হিলসের কর্তারা বলছেন, বরাবর ‘কপিবুক’ রাজনীতি করে আসা প্রণববাবু সেই পরিস্থিতিতেই বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন। কারণ, সরকার গঠন নিয়ে কোনও বিতর্ক যাতে তৈরি না হয়, এক দিকে সেটা তাঁকে সুনিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি এ-ও দেখতে হবে, তিনি যাদের ডাকবেন, তারা স্থায়ী সরকার করতে পারবে কি না।
এই অবস্থার কথা মাথায় রেখেই যাবতীয় প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন রাষ্ট্রপতি। সূত্রের দাবি, প্রণববাবু এর আগের পনেরোটি লোকসভায় সরকার গঠনের প্রক্রিয়ার ইতিহাসই শুধু ঘেঁটে দেখছেন না, এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির কর্তব্য এবং সাংবিধানিক এক্তিয়ার খতিয়ে দেখতে সংবিধান বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও পরামর্শ শুরু করেছেন। সংবিধান ও আইনি বিষয়ে পরামর্শের জন্য প্রাক্তন কেন্দ্রীয় আইন সচিব তথা লোকসভার প্রাক্তন সেক্রেটারি জেনারেল টি কে বিশ্বনাথনকে ইতিমধ্যেই উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ করেছেন রাষ্ট্রপতি। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রপতি আরও কয়েক জন সংবিধান বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিচ্ছেন বলেও খবর। ইতিমধ্যেই তিনি ডেকে পাঠিয়ে কথা বলেছেন প্রাক্তন সলিসিটর জেনারেল মোহন পরাশরণ, সোলি সোরাবজি, ফলি নরিম্যানের সঙ্গে। ভোটপর্ব মেটার পরে মঙ্গলবার থেকেই তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করতে শুরু করেছেন। যেমন আজই তিনি বৈঠক করেছেন কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী এবং রাজ্যসভায় বিজেপির উপনেতা রবিশঙ্কর প্রসাদের সঙ্গে।
রাইসিনা হিলস্ সূত্রের খবর, সরকার গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অতীত দৃষ্টান্তও খতিয়ে দেখতে শুরু করেছেন রাষ্ট্রপতি। কারণ এ দেশের সংসদীয় ব্যবস্থা অনেকটাই ব্রিটিশ ব্যবস্থার অনুকরণে গড়ে উঠেছে।
রাষ্ট্রপতির সচিবালয় সূত্রের খবর, রাষ্ট্রপতি ভবনের পাঠাগার থেকে ব্রিটিশ সাংবিধানিক ব্যবস্থার ওপর কিছু বই ইতিমধ্যেই পড়ে ফেলেছেন রাষ্ট্রপতি। সেই সঙ্গে নেহরু পাঠাগার থেকেও কিছু বই আনা হয়েছে। তার মধ্যে থেকে প্রাসঙ্গিক অংশ নিয়ে নোটও প্রস্তুত করা হয়েছে। ওই সব বইয়ের মধ্যে রোডনি ব্রেজিয়ারের লেখা ‘কনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস’-এর দ্বিতীয় সংস্করণ ছাড়াও রয়েছে এ ডব্লিউ ব্র্যাডলি এবং কে ডি ইউইংয়ের লেখা সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক আইন সংক্রান্ত বই। এ ছাড়াও সরকার গঠন সংক্রান্ত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতিদের সচিবদের তৈরি নোট এবং সরকারিয়া কমিশনের রিপোর্টও খতিয়ে দেখছেন প্রণববাবু। এমনকী অতীতের বিভিন্ন জটিল পরিস্থিতিতে কী হয়েছিল, সে সবও খুঁজে খুঁজে বার করে আনছেন। এ ব্যাপারে উদাহরণ দিতে গিয়ে রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের এক কর্তা ১৯৭১ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোটের প্রসঙ্গও তুলে আনেন। তিনি জানান, সে বার সিপিএম একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল। কিন্তু সরকার গঠন থেকে সিপিএম-কে ঠেকাতে রাজ্যের অন্য দলগুলি একজোট হয়ে চিঠি দেয় রাজ্যপালের কাছে। ফলে রাজ্যপাল সিপিএমের পরিবর্তে তাদের সরকার গড়তে ডাকেন।
বস্তুত রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রণববাবু নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই রাজনৈতিক শিবিরে তাঁর ভূমিকা নিয়ে নানান জল্পনা ও কৌতূহল রয়েছে। বিশেষ করে সরকার গড়ার ক্ষেত্রে এ-ও কৌতূহল যে, প্রণববাবু প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি শঙ্করদয়াল শর্মা-র মডেল অনুসরণ করবেন, নাকি প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি কে আর নারায়ণনের পথ অনুসরণ করবেন। কারণ, শঙ্করদয়াল শর্মা ভোটের পর সংখ্যাগরিষ্ঠ দলকে প্রথমে সরকার গড়তে ডেকেছিলেন। কিন্তু কে আর নারায়ণন প্রাক্-ভোট সংখ্যাগরিষ্ঠ জোটকে সরকার গড়তে ডাকার আগে শরিকদের সমর্থনপত্রও দেখতে চেয়েছিলেন। সরকারের স্থায়িত্বের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েই তিনি ১৯৯৯ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ীকে সরকার গড়তে আহ্বান জানান।
এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের এক আমলা বলেন, পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে শঙ্করদয়াল শর্মার মডেল ত্রুটিপূর্ণ বলেই মনে করা হয়। কারণ, তিনি ১৯৯৬ সালে ভোটের পর সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে বিজেপি তথা অটলবিহারী বাজপেয়ীকে সরকার গঠনের জন্য ডেকেছিলেন। কিন্তু সেই সরকার দু’সপ্তাহও টেকেনি। তুলনায় কে আর নারায়ণনের মডেল নিয়ে কম প্রশ্ন ওঠে। তবে রাষ্ট্রপতি কাকে সরকার গড়তে ডাকবেন, তা নিয়ে সংবিধানে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। অতীতে রাষ্ট্রপতিরা তাঁদের বিবেচনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু দেখা গিয়েছে, ষষ্ঠ, নবম এবং একাদশ লোকসভায় সরকার গঠন নিয়ে সর্বাধিক বিতর্ক হয়েছে। ১৯৮৯ সালে সরকার গঠন নিয়ে সমস্যায় পড়েছিলেন রাষ্ট্রপতি আর ভেঙ্কটরমন। ১৯৬টি আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হয়েও সে বার সরকার গঠন করতে চাননি রাজীব গাঁধী। তখন লালকৃষ্ণ আডবাণীকে ডাকেন রাষ্ট্রপতি। ঘটনাচক্রে দিনটি ছিল আডবাণীর জন্মদিন। বেঙ্কটরমন তাঁকে বলেছিলেন, আপনি সরকার গড়ুন। আপনাকে জন্মদিনের উপহার দিচ্ছি। কিন্তু আডবাণীও রাজি না হওয়ায় ভি পি সিংহকে সরকার গড়তে ডাকেন তিনি। দেখা যায় সেই সরকার প্রথম থেকেই ভঙ্গুর।
রাইসিনা হিলস সূত্রে বলা হচ্ছে, এই সব অভিজ্ঞতার নিরিখেই সমস্ত সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে নিজেকে তৈরি রাখছেন রাষ্ট্রপতি।