মুখ্যমন্ত্রীকে মোদীর লেখা আমন্ত্রণপত্র হাতে ফিরহাদ হাকিম। শুক্রবার নবান্নে সাংবাদিক বৈঠকে।—নিজস্ব চিত্র।
সৌজন্য দেখাতেও বাধো বাধো ঠেকছে। আবার বয়কট করলেও প্রশ্নের মুখে পড়তে হতে পারে। নরেন্দ্র মোদীর কাছ থেকে তাঁর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে হাজির থাকার আমন্ত্রণ পেয়ে উভয়সঙ্কটে তৃণমূল।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তিনি নিজে যাবেন না। আমন্ত্রণ রক্ষা করবেন মুকুল রায় ও অমিত মিত্র। অর্থাৎ দলের পক্ষ থেকে এক জন, রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে এক জন প্রতিনিধি পাঠানো হচ্ছে। মমতা নিজে কেন যাবেন না? পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম জানিয়েছেন, ২৬ মে নজরুলের জন্মজয়ন্তী অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করবেন মুখ্যমন্ত্রী। তাই শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে থাকতে পারবেন না। তৃণমূল সূত্র বলছে, এটা আদতে দু’কুল রাখার চেষ্টা। এক দিকে দিল্লির দরজা খুলে রাখা হল। অন্য দিকে, একটা বার্তাও দেওয়া গেল সংখ্যালঘু ভোট ব্যাঙ্ককে।
মোদী ঝড়ে কার্যত মুছে যাওয়া সিপিএমের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব অবশ্য এখনও দোলাচলে। সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট বলেন, “দলের কাছে কোনও আমন্ত্রণ আসেনি। শুনেছি, কয়েক জন সাংসদ আলাদা ভাবে আমন্ত্রণ পেয়েছেন।” সাংসদরা কি নিজেরা চাইলে যেতে পারেন? নাকি দলের তরফে নির্দেশ জারি করা হবে? কারাটের জবাব, “শনিবার সকালে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।” তবে শেষ পর্যন্ত সংসদীয় দলনেতা সীতারাম ইয়েচুরিকে পাঠানো হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁর কাছে কোনও আমন্ত্রণপত্র আসেনি।
পশ্চিমবঙ্গের সিপিএম সাংসদরা কিন্তু শপথগ্রহণে হাজির থাকবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছেন। যার পিছনে সংখ্যালঘু ভোট আরও হারানোর ভয় কাজ করছে বলেই মনে করা হচ্ছে। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র আজ বলেন, “আমাদের এখান থেকে কেউ যাবেন না। ১৯৯৯ সালে বাজপেয়ী সরকারের শপথ নেওয়ার সময়েও আমাদের কেউ যাননি।”
২৬ মে, সোমবার রাষ্ট্রপতি ভবনে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার অনুরোধ জানিয়ে নরেন্দ্র মোদীর সই করা চিঠি বৃহস্পতিবারই এসে পৌঁছয় মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। তার পরে কাউকে না-পাঠালে অভিযোগ উঠত, রাজ্য সরকার অনুষ্ঠান বয়কট করেছে। তাই অমিত মিত্রকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়।
কিন্তু মুকুল রায় যাচ্ছেন কেন? শুক্রবার নবান্নে ফিরহাদ হাকিম প্রথমে জানান, শপথগ্রহণে সরকারের পক্ষ থেকে উপস্থিত থাকবেন অমিত মিত্র এবং দলের পক্ষ থেকে মুকুল রায়। পরে আবার এসে তিনি বলেন, “অমিত মিত্র এবং মুকুল রায় দু’জনেই সরকারের পক্ষ থেকে উপস্থিত থাকবেন।” মুকুলবাবু সরকারের প্রতিনিধি কী ভাবে হবেন, এই প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রীর যুক্তি, “তিনি রাজ্যসভায় দলের নেতা। তাঁকে মুখ্যমন্ত্রীই প্রতিনিধি হিসেবে বেছে নিয়েছেন।”
তৃণমূল সূত্রে বলা হচ্ছে, দল শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান থেকে গা বাঁচিয়ে চলতে চাইলেও দলের অধিকাংশ সাংসদ ব্যক্তিগত ভাবে অনুষ্ঠানে হাজির থাকার পক্ষে। তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য সেই রাস্তা বন্ধ করতে ৩০ মে কলকাতায় দলীয় বৈঠক ডেকেছেন। তার পরে সাংসদরা দিল্লিতে যাবেন। এই অবস্থায় মুকুলবাবুকে পাঠানোর যুক্তি হিসেবে তৃণমূলের একাংশ বলছে, বাংলার সিপিএম শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান বয়কট করতে চলেছে বুঝেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর ফলে সিপিএমের সঙ্গে একাসনে বসার অভিযোগ এড়ানো যাবে। দলের অন্য অংশের মতে অবশ্য, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক প্রথম থেকেই তিক্ত করতে না চেয়ে দলের শীর্ষ নেতা মুকুলবাবু ও রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী অমিতবাবুকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। কারণ, রাজ্যের উন্নয়নের প্রশ্ন এবং আর্থিক সাহায্যের বিষয়ে কেন্দ্রের সাহায্য দরকার হবেই।
সম্পর্ক তিক্ত করতে চাই না, এই বার্তা দেওয়াই যদি উদ্দেশ্য হয়, তা হলে প্রাথমিক ভাবে অন্তত তৃণমূল সফল। প্রচার পর্বে বরাবরই রাজ্যের দাবিদাওয়ার প্রতি সহানুভূতি দেখানো বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিংহ আজ বলেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে তাঁর প্রতিনিধি পাঠাচ্ছেন, এতে আমি খুশি। এই সৌজন্য থাকা উচিত। মমতা নিজে এলে আরও খুশি হব।” তবে মমতার না-যাওয়া প্রসঙ্গে বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের কটাক্ষ, “প্রোটোকল এবং সৌজন্য দেখাতে মুখ্যমন্ত্রীরই উপস্থিত থাকা উচিত ছিল। কিন্তু মোদী সম্পর্কে ওঁর সাম্প্রতিক সব মন্তব্যের জন্যই হয়তো যাওয়ার মুখ নেই!”
আর প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলছেন, “আসলে সিবিআইয়ের ভয়ে এই সিদ্ধান্ত। ক’দিন আগেই না কি তৃণমূল সরকার মোদীকে জেলে পুরছিল। এখন সেই হরিদাস পালের শপথেই নিজেদের পিঠ বাঁচাতে মমতার প্রতিনিধিরা হাজির হচ্ছেন।”
ভোটপ্রচারে মমতার সঙ্গে তাঁর যতই উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হোক না কেন, প্রচারপর্ব মিটতেই সৌজন্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন মোদী। প্রধানমন্ত্রী হয়ে পশ্চিমবঙ্গের উন্নতির জন্য যে তিনি সচেষ্ট হবেন, সেই বার্তাও দিয়েছেন। তৃণমূল নেতারা মনে করছেন, সবটাই সৌজন্যের রাজনীতি নয়। মোদীরও তৃণমূলকে দরকার পড়তে পারে। রাজ্যসভায় কোনও বিল পাশ করাতে সাহায্য লাগতে পারে। কিন্তু ঘটনা হল, মমতা নিজে নির্বাচনের সময় মোদীকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছেন, কখনও হরিদাস পাল বলেছেন, কখনও জেলে পোরার হুমকি দিয়েছেন। কিন্তু বিজেপি যে একাই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যাবে, তা আঁচ করতে পারেননি। তাই এখন মোদীর আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে পাল্টা সৌজন্য দেখাতে অস্বস্তি হচ্ছে তাঁর।
এখানেই প্রশ্ন উঠছে, বাংলার রাজনীতিতে সৌজন্যের এত অভাব কেন? যেখানে সনিয়া গাঁধী নিজে মোদীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন, সেখানে তৃণমূল বা সিপিএমের তরফে মোদীকে অভিনন্দন জানানো হয়নি। উল্টে শপথ বয়কটের কথা তাদের মনে এসেছে। প্রবীণ রাজনৈতিক নেতাদের মতে, বাংলার রাজনীতিতে এই সৌজন্যের অভাব আগে ছিল না। বিধান রায় বা জ্যোতি বসুর মধ্যেও যথেষ্ট সুসম্পর্ক ছিল। কিন্তু পরবর্তী কালে রাজনৈতিক রেষারেষি ব্যক্তিগত আক্রমণের পর্যায়ে চলে যায়। দু’দলের নেতাদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়। দিনে দিনে ‘আমরা-ওরা’-র রাজনীতিটাই রাজ্যে শিকড় গেড়েছে। গুজরাতের কংগ্রেস নেতা শঙ্করসিন্ বাঘেলা মোদীকে কটাক্ষ করেও তাঁকে আলিঙ্গন করতে পারেন। অথচ পশ্চিমবঙ্গে এই দৃশ্য বিরল।
সেই কারণেই দিল্লির সিপিএম নেতারা মোদীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান পুরোপুরি এড়িয়ে যেতে না চাইলেও বাংলার নেতারা বয়কটের সিদ্ধান্তে অনড়। সিপিএমের কেন্দ্রীয় নেতাদের একাংশের যুক্তি, প্রধানমন্ত্রী শপথগ্রহণ কোনও দলীয় অনুষ্ঠান নয়। ইউপিএ-১ সরকার থেকে বামেরা সমর্থন তুলে নেওয়ার পরে ২০০৯ সালে যখন মনমোহন সিংহ ফের প্রধানমন্ত্রী হয়ে এলেন, তখন সেই সরকারও বামেদের কাঙ্ক্ষিত ছিল না। তবু তাঁর শপথ অনুষ্ঠানে বাম প্রতিনিধি ছিলেন। ওই নেতাদের মতে, মোদী আর মনমোহনকে এক করে না দেখলেও দেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর শপথ পুরোপুরি বয়কট করা অনুচিত।
কী করবেন ত্রিপুরার বাম মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার? সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের বক্তব্য, রাজ্য সরকার বা দলের কাছে এখনও আমন্ত্রণপত্র আসেনি। তাই মুখ্যমন্ত্রীরও দিল্লি-যাত্রার কোনও খবর নেই।