অর্ধ-শতাব্দীরও আগের কথা। মাও জে দং এর সমাজতন্ত্রী চিন তখন এ দেশের কমিউনিস্ট নেতাদের অনেকেরই আদর্শ। ১৯৬২-র ভারত-চিন যুদ্ধের সময় তাঁরা জওহরলাল নেহরুর সরকারকে পুরোপুরি সমর্থন করেননি। কপালে ‘চিনের দালাল’-এর বিশেষণই শুধু জোটেনি, জেলেও ভরে দেওয়া হয়েছিল এই সে দিনও আলিমুদ্দিনের সিপিএম নেতারা ‘লাল চিন’-এর আদলে পশ্চিমবঙ্গে উন্নয়নের স্বপ্ন দেখতেন।
তার পরে হোয়াংহো-গঙ্গা দিয়ে কত জল বয়ে গিয়েছে! মাও জে দং-এর ছবি সিপিএমের অনেক দফতরে ঝোলানো থাকলেও মাও-এর নামে গড়া দলের নাম শুনলে হৃৎকম্প হয় তাঁদের অনেকের! তা ছাড়া সেই চিনও তো আর নেই! সব মিলিয়ে চিন সম্পর্কে এ দেশের সিপিএম নেতাদের সিংহ ভাগেরই মোহভঙ্গ হয়েছে।
চিন যে আর সিপিএমের কাছে আদর্শ নয়, চিনা কমিউনিস্ট পার্টির কথা যে আর সিপিএমের কাছে বেদবাক্য নয়, তা চিনে গিয়েই প্রমাণ দিলেন সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি।
এশিয়ার সঙ্গে ইউরোপের বাণিজ্যের প্রাচীন ‘সিল্ক রোড’ নতুন করে চালু করতে চাইছে চিন। তাতে অবশ্য নরেন্দ্র মোদী সরকারের তেমন উৎসাহ নেই। মুখে না বললেও দিল্লির আশঙ্কা, বাণিজ্যপথ চালু করার নামে আসলে গোটা এলাকায় কর্তৃত্ব কায়েম করতে চায় চিন। তাতে ভারতের নিরাপত্তার ঝুঁকি রয়েছে। নয়াদিল্লি চায়, সমুদ্র পথে বাণিজ্যের পুরনো ‘স্পাইস রুট’ নতুন করে
চালু করতে। যে পথে আগে ভারতীয় মশনা রফতানি হতো বিশ্ব জুড়ে। বেজিংয়ে গিয়ে সেই কথারই প্রতিধ্বনি করেছেন ইয়েচুরি।
দিল্লির সরকারকে বোঝাতে না পেরে এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলিকে আলাদা করে ‘সিল্ক রোড’-এর উপকারিততা বোঝানোর পরিকল্পনা করেছিল চিন। বেজিংয়ে গত তিন দিনের এক সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল এ দেশের রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের। কংগ্রেস-সহ অন্য একাধিক দলের নেতারা তো ছিলেনই। কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদকের উপর বিশেষ ভাবে ভরসা করেছিলেন চিনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা।
কিন্তু সে গুড়ে বালি! বেজিংয়ে দাঁড়িয়ে ইয়েচুরি ‘সিল্ক রোড’ ভাবনার প্রশংসা করেও বলেছেন, ‘সমুদ্র পথে সিল্ক রোডের প্রতিচ্ছবি হল স্পাইস রুট। গুয়াংঝৌ থেকে মালাক্কা প্রণালী, ভারত, শ্রীলঙ্কা ছুঁয়ে আরব, আলেক্সান্দ্রিয়া, ইস্তাম্বুল হয়ে রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্ট্যান্টিনোপল পর্যন্ত যা বিস্তৃত ছিল। একই সঙ্গে বাণিজ্যের এই পথকে ফের চালু না করলে পুরোপুরি ফায়দা তোলা যাবে না’।
ইয়েচুরির এই অবস্থানে চিনের নেতারা কিঞ্চিৎ বিস্মিত হতে পারেন। কিন্তু দলে ইয়েচুরির সহকর্মীরা অবাক নন। তাঁদের যুক্তি, তিন বছর আগে পশ্চিমবঙ্গে বাম জমানার অবসানের পর যে মতাদর্শগত দলিল তৈরি হয়েছিল, সেখানেই চিনের ‘উন্নয়নের মডেল’-এর অন্ধ অনুকরণের রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ওই দলিল তৈরিতে ইয়েচুরি অন্যতম প্রধান ভূমিকায় ছিলেন। চিনে যে ধনী-দরিদ্রের অসাম্য বাড়ছে, সে দেশের কমিউনিস্ট পার্টিতে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা ঢুকে পড়ছেন, নেতারা দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন, তা ওই দলিলেই লেখা হয়েছে। চিনের মডেল বাদ দিয়ে এ দেশের প্রয়োজন অনুযায়ী নীতি তৈরির কথাও সেই দলিলেই বলা হয়। ইয়েচুরির আজকের বেজিংয়ের অবস্থান সেই নীতিরই প্রতিফলন।
শুধু দলের কমরেডরাই নন। বিজেপি-শিবসেনা নেতারাও ইয়েচুরির বেজিং-অবতারে খুশি হতে পারেন। কারণ ওই সম্মেলনে হাজির পাকিস্তানের বিলাবল ভুট্টো কাশ্মীর প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। আন্তর্জাতিক মঞ্চে কাশ্মীর প্রসঙ্গ তোলার জন্য বিলাবলের কড়া সমালোচনা করেছেন ইয়েচুরি। এবং সেটা চিনে বসেই। আসিফ আলি জারদারি-বেনজির ভুট্টোর পুত্র, পাকিস্তান পিপল্স পার্টির চেয়ারম্যান বিলাবল কাশ্মীরের উন্নয়নে চিনের ভূমিকার উল্লেখ করেন। একই সঙ্গে নওয়াজ শরিফের সমালোচনা করে বলেন, পাক-প্রধানমন্ত্রী কাশ্মীর প্রসঙ্গে যথেষ্ট কড়া অবস্থান নিচ্ছেন না। জবাবে ইয়েচুরি স্পষ্ট বলেন, ‘‘পাকিস্তানি প্রতিনিধিদের কাশ্মীর প্রসঙ্গ তোলা দুঃখজনক। গোটা বিশ্ব মেনে নিয়েছে, কাশ্মীর ভারত-পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক বিষয়। দু’পক্ষের মধ্যেই সমাধানের জন্য এই বিষয়টি ছেড়ে দেওয়া ভাল। আন্তর্জাতিক মঞ্চে এই প্রসঙ্গ তুললে জটিলতাই বাড়বে। সমস্যার সমাধান হবে না।’’