শ্রীনগর পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে আহত আরশাদ আহমেদ শাহের। বৃহস্পতিবার। — নিজস্ব চিত্র।
মৃত্যুমিছিলের মাঝে সপরিবার ঘরে ফেরার কাহিনি!
স্ত্রী শবনমের পায়ের একটা হাড় ভেঙে গিয়েছে ঠিকই, ঘাড়ে, মাথায় গুরুতর চোট পেয়েছে দুই সন্তানও। তবুও আনন্দে বিহ্বল বছর চল্লিশের হাকিম জাফর আহমেদ। কারণ একটাই। বিধ্বংসী ভূকম্পকে হার মানিয়ে ঘরে ফিরেছেন তাঁরা।
আদতে শ্রীনগরের রায়নাবাড়ির বাসিন্দা হলেও ব্যবসার সূত্রে ১৯৯৪ সাল থেকে নেপালে থাকতেন হাকিম। বিয়ের পর স্ত্রী শবনমকেও নিয়ে যান সেখানে। দুই সন্তান জায়েদ এবং জিয়াদের জন্ম, বেড়ে ওঠাও এই নেপালেই। শনিবারের ভয়াবহ ভূকম্পে নিমেষের মধ্যে বাস্তুচ্যুত হয়ে যান তাঁরা। তার পর দু’-দু’টো রাত কেটেছে খোলা আকাশের নীচে। কাঠমান্ডুর নয়া বাজার এলাকায় কোনও রকমে মাথা গোঁজার একটা জায়গা করে নিয়েছিলেন। দিন কেটেছে নেপাল সরকারের দেওয়া জল আর শুকনো খাবার খেয়ে। সোমবার গভীর রাতে ভারতীয় বায়ুসেনার বিমানে দিল্লি পৌঁছলেন তাঁরা। শুধু হাকিম আর তাঁর পরিবার নয়। ওই একই বিমানে নেপাল থেকে দিল্লি এসেছেন আরও ৩৬ জন কাশ্মীরি। কেউ পর্যটক, কেউ আবার হাকিমের মতো কাজের তাগিদে ঘাঁটি গেড়েছিলেন নেপালে। ইন্দিরা গাঁধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৩৬ জনের দলটিকে স্বাগত জানান নয়াদিল্লির ডেপুটি রেসিডেন্ট কমিশনার ও সিআইডি-র এসএসপি। মঙ্গলবার ভোরের মধ্যেই শ্রীনগর পৌঁছে যান হাকিম এবং বাকিরা। বিমানবন্দরে পা রেখেই হাঁপ ছাড়েন। আকাশের দিকে মুখ তুলে হাকিম বলে ওঠেন, ‘‘শ্রীনগরে এসে গিয়েছি। আর কিছু আশা করি না।’’ শ্রীনগর বিমানবন্দর থেকে সরাসরি পুলিশ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় আহতদের। হাকিমের স্ত্রী, সন্তানরাও এখন সেখানে চিকিৎসাধীন। হাসপাতালেই তাই থেকে যেতে হয়েছে মধ্যবয়স্ক ওই কাশ্মীরি ব্যবসায়ীকে। সেখান থেকেই ঘটনার বিবরণ দিলেন তিনি।
বছরভর বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা। আর সে জন্যই কাঠমান্ডুতে হস্তশিল্পের একটি দোকান দিয়েছিলেন হাকিম। শনিবার দুপুরে যখন কেঁপে উঠল গোটা নেপাল, দোকানে তখন খরিদ্দার সামলাচ্ছিলেন হাকিম। প্রবল কম্পনে রীতিমতো হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। কী হচ্ছে চারধারে ঠাহর করে উঠতে পারছিলেন না। খেলনা বাড়ির মতো ভেঙে পড়ছিল দোকান সংলগ্ন ঘরবাড়িগুলি। আকাশে ধোঁয়ার রাশি রাশি কুণ্ডলী। প্রায় মিনিট কুড়ি পর সম্বিত ফেরে হাকিমের। দোকান থেকে হাঁটা পথে মিনিট দশেক দূরত্বে একটি ভাড়াবাড়িতে থাকতেন স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে। সম্বিত ফিরতেই ছুট লাগান বাড়ির উদ্দেশে।
ভূকম্প টের পেয়ে তত ক্ষণে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এসেছেন শবনমরা। হাকিম যখন পোঁছলেন, মাটিতে বসে তখন চিৎকার করে কাঁদছেন শবনম। ভয়, আতঙ্কে সংজ্ঞা হারিয়েছে জায়েদ আর জিয়াদ। দুই সন্তানকে কোলে নিয়ে নয়া বাজারের শিবিরে পৌঁছন হাকিম। পা হিঁচড়ে হিঁচড়ে সঙ্গে আসেন শবনমও।
হাকিম-শবনমের মতো এ যাত্রা বেঁচে ফিরেছেন শ্রীনগরের আরশাদ আহমেদ শাহ-ও। ভূকম্পের জেরে কাঠমান্ডুর বাজেট হোটেলের ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। আরশাদের সঙ্গে চাপা পড়েছিলেন তাঁর বন্ধু সাজ্জাদ আহমেদ। বেঁচে ফেরাটাই এখন স্বপ্নের মতো তাঁদের কাছে। উদ্ধারের পর যখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তখনও হুঁশ ছিল আরশাদের। হাসপাতালের ঘরগুলিতে সারি সারি দেহ পড়ে থাকতে দেখেছেন। যার বেশির ভাগই শিশুর। রক্তে ভেজা দেহগুলি দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। হাসপাতালে তাই থাকতে চাননি এক দণ্ড। প্রাথমিক চিকিৎসার পর আরশাদকে তাই সরিয়ে নিয়ে আসা হয় নয়া বাজারের শিবিরে।
নয়া বাজারে এসেই হাকিম, আরশাদরা খবর পান ভারত সরকার নাগরিকদের উদ্ধারের বন্দোবস্ত করেছে। নিজেদের মধ্যে থেকে তিন জনকে নেপালের বিমানবন্দরে পাঠান তাঁরা। ভারতীয় দূতাবাসের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেন তাঁরাই। দূতাবাসের আধিকারিকদের উদ্যোগে সোমবার দুপুরে নেপালের বিমানবন্দরে পোঁছয় ৩৬ জনের দলটি। স্থানীয় সময় রাত ন’টা নাগাদ দিল্লি ফেরার বিমান ধরেন।
কাশ্মীরের পুলিশ হাসপাতালে এখন আহতদের চিকিৎসা করছেন চিকিৎসক সুহেল। তাঁদের সকলের অবস্থাই স্থিতিশীল বলে জানিয়েছেন তিনি। আহতদের সঙ্গে কথা বলেছেন কাশ্মীর পুলিশের ইনস্পেক্টর জেনারেল এসজিএম গিলানি। গিলানির কাছেই দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য ভারত সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন তাঁরা। সেই কথোপকথনের ফাঁকে নেপালে আটকে থাকা অন্য কাশ্মীরিদের নাম পরিচয়ও জেনে নিয়েছেন গিলানি।
তবে ঘরে ফেরার আনন্দ পুরোপুরি ভুলিয়ে দিতে পারেনি দুঃস্বপ্নের দিনটার কথা। প্রিয় শহরের শেষ স্মৃতিটুকু এখনও তাড়া করছে তাঁদের। সব কিছু কাটিয়ে নেপাল ফের সেজে উঠবে। সেজে উঠবে প্রাণকেন্দ্র কাঠমান্ডু। এখন এই আশাতেই বুক বাঁধছেন তাঁরা।