একের পর এক জনমোহিনী নীতি নেওয়া, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ডাক, বিভিন্ন প্রকল্প ঘোষণা করা রাজ্যের বিজেপি-অগপ-বিপিএফ জোট সরকারের বিরুদ্ধে এই প্রথম সরব হলেন রাজ্যের আম জনতা। চাংসারিতে এইমস তৈরির বিরুদ্ধে বা ১২টি তৈল ক্ষেত্রের নিলাম নিয়েও চলছিল প্রতিবাদ। অবশ্য তা সরাসরি রাজ্যের ৩ কোটি ২০ লক্ষ মানুষকে সরাসরি আঘাত করেনি। কিন্তু রান্নার গ্যাসে ভর্তুকি হ্রাস, পেট্রোল-ডিজেলে অতিরিক্ত কর আরোপ করা এবং ১২৭টি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য, এমনকী ওষুধের উপরেও মূল্যযুক্ত কর (ভ্যাট) বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সাধারণ মানুষের উপর সরাসরি প্রভাব পড়ল। কর বাড়ানোর পাশাপাশি, যে ভাবে গত ২ জুলাই নেওয়া সিদ্ধান্ত এত দিন গোপন রাখা হয়েছিল—তাও মানুষকে ক্ষিপ্ত করেছে। আন্দোলন শুরু হয়েছে রাজ্যের বিভিন্ন অংশে। প্রবল চাপের মুখে পড়ে এ দিন মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল জানান, ভ্যাট বাড়ানোর ফলে যাতে এমআরপি না বাড়ে সে দিকে নজর রাখা হবে।
মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠক হয় গত ২৭ জুন। বৈঠকের পরে সিদ্ধান্তগুলি নিয়ে বিবৃতি প্রকাশের পাশাপাশি সাংবাদিক সম্মেলনও করেন পূর্ত ও আবগারিমন্ত্রী পরিমল শুক্লবৈদ্য। জানানো হয়, মাজুলি জেলা হচ্ছে, টেট উত্তীর্ণ দশ হাজার প্রার্থী চাকরি পাবেন। নিযুক্ত হবেন ৭০০ চিকিৎসক, সিনেমার টিকিটে কর ছাড় দেওয়া হবে ইত্যাদি। কিন্তু বৈঠকে যে রান্নার গ্যাসে ১৪ টাকার ভর্তুকি তুলে দেওয়া, ১২৭টি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যে ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬ শতাংশ করা, পেট্রোলে রাজ্য সরকারের বিক্রয় কর ২৭.৫ শতাংশ থেকে ২৯ শতাংশ ও ডিজেলে ১৬.৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করার যে সিদ্ধান্তগুলি নেওয়া হয়েছিল, তা নিয়ে কোনও উল্লেখ ছিল না। গত কাল বিকেলে সরকারি গেজেট নোটিফিকেশন প্রকাশিত হওয়ার পর ঘটনা প্রকাশ্যে আসে।
শাসনভার হাতে নিয়েই শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছিলেন অর্থমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা। আগের সরকার রাজ্যের উপরে ১০ হাজার কোটি টাকার বোঝা চাপিয়ে গিয়েছে বলে দাবি করলেও তিনি এবং মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ জানিয়েছিলেন, মানুষের উপরে কর চাপিয়ে টাকা আদায় করা হবে না। কেন্দ্র থেকে টাকা আনা হবে। আদায় করা হবে বকেয়া ১০ হাজার কোটি টাকার তেল রাজস্ব। কিন্তু দেড় মাসের মধ্যেই ভোল বদল! সেই কর চাপিয়েই টাকা আদায়ের রাস্তায় হাঁটল সরকার। বিজেপির সাধারণ সম্পাদক বিজয় গুপ্ত বলেন, ‘‘আগের সরকারের না মেটানো টাকা, বকেয়া বিল, জনকল্যাণ নীতি, আর্থিক দায়দায়িত্ব মিলিয়ে সরকারকে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা জোগাড় করতে হত। তাই এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে সরকার। কর বাড়ানোয় রাজ্য সরকার বছরে ৫০০ কোটি অতিরিক্ত রাজস্ব পাবে।’’
কংগ্রস কেন্দ্রের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সরব ছিল। এবার রাজ্যের বিজেপি জোট সরকারও একই রাস্তা নেওয়ায় তারাও প্রতিবাদের সুযোগ পেল। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ, বিরোধী দলনেতা দেবব্রত শইকিয়ারাদের মতে, বিজেপির প্রতিশ্রুতি, জনমোহিনী চেহারা, পরিবর্তনের ডাক আসলে যে মুখোশ সে ব্যাপারে কংগ্রেস রাজ্যবাসীকে আগেই সতর্ক করেছিল। তারা সুযোগ পেলেই জনতার উপরে চাপ বাড়াবে। নতুন সরকার আসার দেড় মাসেই আসল চেহারা সামনে চলে এল। শইকিয়ার মতে, ‘‘প্রাণদায়ী ওষুধ, কৃষিতে ব্যবহৃত সামগ্রী, রান্নার দৈনন্দিন জিনিসে দাম এত বাড়িয়ে বিজেপি সরকার অন্যায় করল।’’ কংগ্রেস মুখপাত্র অপূর্ব ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘বিজেপি ক্ষমতায় এসে বলেছিল কর চাপাবে না, কেন্দ্র থেকে টাকা আনবে। কিন্তু আদতে কেন্দ্র থেকে কিছুই আনতে না পেরে বাজেট অধিবেশনের ঠিক আগে গোপনে তারা মূল্যবৃদ্ধি করল।’’
সরকার গড়ার পর থেকেই তৈলক্ষেত্র নিলাম, হিন্দু অনুপ্রবেশকারীদের নাগরিকত্ব দেওয়া, চাংসারিতে এইমস গড়া নিয়ে শরিক অগপর সঙ্গে বিজেপির বিরোধ সামনে এসেছে। এ বার দাম বাড়ানো নিয়েও সরাসরি বিজেপির সমালোচনা করলেন অগপ বিধায়ক তথা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল মহন্ত। তিনি আজ স্পষ্টই বলেন, ‘‘এত জনপ্রিয় একটি সরকার এমন দ্রুত দাম বাড়াবে, জনবিরোধী নীতি নিতে থাকবে—তা অসমের মানুষ ভাবতেও পারেননি। এই ঘটনা দুর্ভাগ্যজনক।’’
কিন্তু কেন চেপে যাওয়া হল মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত? কেনই বা চাপানো হল কর?
পূর্ত ও আবগারি দফতরের মন্ত্রী পরিমল শুক্লবৈদ্য আজ বলেন, ‘‘রাজ্য সরকারের উপরে বিরাট আর্থিক বোঝা রয়েছে। বোঝা আরও বাড়তে চলেছে। সামান্য কর না চাপিয়ে উপায় ছিল না। কেন্দ্র আমাদের ৯০ শতাংশ টাকা দিলেও বাকি ১০ শতাংশ অন্তত তো আমাদেরই দিতে হবে। তা দেওয়ার অবস্থাতেও ছিল না রাজ্য।’’
কিন্তু এই সিদ্ধান্ত তো মানুষকে ক্ষিপ্ত করবে। পরিমলবাবুর মতে, ‘‘জানি মানুষ প্রথমে রাগ করলেও আমাদের অবস্থা বুঝবেন। দাম এমন কিছু বাড়ানো হয়নি। বিরোধীরা বেশি হইচই করছে। রাজ্যের উন্নয়নের স্বার্থেই এই সিদ্ধান্ত।’’ কিন্তু মন্ত্রিসভার বৈঠকের পরে সাংবাদিক সম্মেলনে কেন এই খবরটি চেপে যাওয়া হল? মন্ত্রীর দাবি, বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হলেও সাংবাদিক সম্মেলনে অনেক বিষয় নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ওই আলোচনার কথা নাকি তাঁর মাথায় ছিল না। সরকারি সাফাইয়ে মন ভিজছে না রাজ্যবাসীর। এ দিন রাজ্যের বিভিন্ন অংশে দাম বাড়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে। বিভিন্ন সংগঠন, যারা এক সময় বিজেপিকে সমর্থন জানিয়েছিল, তারাও মুখ্যমন্ত্রীর কুশপুতুল পোড়ান। চাপে মুখে দাঁড়িয়ে সর্বানন্দ এ দিন যোরহাটে জানান, ‘‘ভ্যাট বাড়লেও এমআরপি বাড়বে না। অতিরিক্ত কর উৎপাদনকারীদের বহন করতে হবে। পাইকারি ও খুচরো মূল্যের ব্যবধান কমলেও মানুষকে এমআরপির চেয়ে বেশি দামে কিছু কিনতে হবে না।’’
কিন্তু ব্যবসায়ী সংগঠনগুলি জানায়, সাধারণত মানুষ ওষুধ বা অন্যান্য সামগ্রী লিখিত এমআরপির চেয়ে কম দামেই পান। অতিরিক্ত ভ্যাটের জেরে ক্রেতাদের কাছ থেকে এ বার এমআরপিই নেওয়া হবে। তাই মানুষকে টাকা বেশি দিতে হচ্ছেই। এপিডব্লিউয়ের সভাপতি অভিজিৎ শর্মার মতে, পরিবর্তন নয়, এ তো ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। জোট সরকার ক্ষমতায় এসেই দাম কমানো, চেক গেট বন্ধ করা, দুর্নীতি বন্ধ করা, গন্ডার হত্যা বন্ধ করার কথা ঘোষণা করেছিল। কিন্তু বাস্তবে কিছুই হয়নি, উল্টে বেড়ে গেল নিত্যপণ্য ও জ্বালানীর দাম। কৃষক মুক্তি সংগ্রাম সমিতির নেতা অখিল গগৈ বলেন, ‘‘ এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না করলে অসমবাসী আন্দোলনে নামবেন।’’ সিপিএম ও এআইইউডিএফও এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে।