বিক্ষুব্ধদের বৈঠক নিয়ে কিছু বলার আগেই পঞ্জাবের সাংসদদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েও সনিয়া আজ দলের মধ্যে অসন্তোষ টের পেয়েছেন।
ফাইল চিত্র।
গান্ধী পরিবারের সদস্যদের সরে দাঁড়ানোর কথা বলে আবেগের তাস খেলা, প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতিদের পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে সক্রিয়তা দেখানো, দলের বাইরে মুখ খোলায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থার হুঁশিয়ারি— সনিয়া গান্ধীর কোনও কৌশলেই কাজ হল না। গান্ধী পরিবারকে কার্যত প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আজ কংগ্রেসের বিক্ষুব্ধ জি-২৩ গোষ্ঠীর নেতারা বৈঠকে বসলেন। গান্ধী পরিবারের রক্তচাপ আরও বাড়িয়ে যাঁরা আদতে জি-২৩ গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন না, আজ এমন কয়েক জন নেতাও ওই বৈঠকে যোগ দিলেন।
দলের মধ্যে যাঁরা খাতায় কলমে বিক্ষুব্ধ নন, তাঁরাও যে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের কাজকর্মে বিরক্ত, আজ সনিয়া গান্ধী তা-ও টের পেয়েছেন। পঞ্জাবে কংগ্রেসের ক্ষমতা হারানোর পরে নির্বাচনের ফল নিয়ে আজ সনিয়া গান্ধী সে রাজ্যের সাংসদদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন। সেখানে সনিয়ার সামনেই তাঁর ও রাহুল গান্ধীর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দেন পঞ্জাবের সাংসদরা। রাহুল গান্ধী যাঁকে পঞ্জাবের দায়িত্বে পাঠিয়েছেন, তিনি টাকা নিয়ে দলের টিকিট নিলাম করেছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
উত্তরপ্রদেশ-সহ পাঁচ রাজ্যে কংগ্রেসের ভরাডুবির পরেই বিক্ষুব্ধরা সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। গুলাম নবি আজাদের নেতৃত্বে যে ২৩ জন নেতা বা জি-২৩ গোষ্ঠী দলের হাল শোধরানোর দাবি নিয়ে সনিয়াকে চিঠি লিখেছিলেন, তাঁদের কয়েক জন ভোটের ফল প্রকাশের পরেই গুলাম নবির বাড়িতে বৈঠক করেন। এর পর কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে সনিয়া বলেন, দলের স্বার্থে তিনি, রাহুল ও প্রিয়ঙ্কা যে কোনও পদ ছাড়তে রাজি। তাতেও অবশ্য কাজ হয়নি। জি-২৩-র অন্যতম সদস্য কপিল সিব্বল সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেন, কারও বলার অপেক্ষা না করে গান্ধী পরিবারের স্বেচ্ছায় নেতৃত্ব থেকে সরে যাওয়া উচিত।
আজ সেই সিব্বলের বাড়িতে জি-২৩-র সদস্যদের নৈশভোজে মিলিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সিব্বলের গান্ধী পরিবার সম্পর্কে মন্তব্যে বিক্ষুব্ধরা সকলে সহমত জানাননি। সন্ধ্যায় গুলাম নবির বাড়িতে বৈঠক বসে। সেখানে আনন্দ শর্মা, মণীশ তিওয়ারি, ভূপেন্দ্র সিংহ হুডা, শশী তারুর, পৃথ্বীরাজ চহ্বাণ, প্রাণিত কৌর, অখিলেশ প্রসাদ সিংহ, রাজ বব্বর, রাজেন্দ্র কৌর ভট্টল, সন্দীপ দীক্ষিতরা হাজির হন। পি জে কুরিয়েন, শঙ্কর সিংহ বাঘেলাও সেখানে হাজির হন, যাঁরা জি-২৩-র সদস্য নন।
এমনকি গান্ধী পরিবারের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত মণিশঙ্কর আইয়ারও বৈঠকে হাজির হন। তবে তিনি সম্ভবত গান্ধী পরিবারের প্রতিনিধি হিসেবেই ছিলেন বৈঠকে।
বৈঠকের শেষে একটি দাবিপত্র প্রকাশ করেন বিক্ষুব্ধরা। তাতে বলা হয়েছে, কংগ্রেসের স্বার্থেই নেতৃত্বকে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অর্থাৎ, বাকি নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিন রাহুল। অন্য বিজেপি-বিরোধী দলকে একজোট করার কাজও করতে হবে কংগ্রেস নেতৃত্বকে। বিক্ষুব্ধ নেতারা বলেছেন, এ ভাবেই ২০২৪-এ বিজেপিকে মোকাবিলা করতে পারবে কংগ্রেস। সূত্রের খবর, আজাদের সঙ্গে কাল বৈঠকে বসতে পারেন সনিয়া।
বৈঠকের আগেই কংগ্রেসের মল্লিকার্জুন খড়্গে-সহ গান্ধী পরিবারের অনুগামীরা সিব্বলকে তোপ দাগতে শুরু করেন। তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার দাবি তোলেন। খড়্গে বলেন, “সিব্বল ভাল আইনজীবী, কিন্তু ভাল নেতা নন। তিনি কোনও দিন কংগ্রেসের হয়ে কাজ করতে কোনও গ্রামে যাননি। এখন তিনি কংগ্রেসকে দুর্বল করার চেষ্টা করছেন। কেউ একটা কেন, একশোটা বৈঠক ডাকতে পারেন। তাতে সনিয়া গান্ধীকে দুর্বল করা যাবে না।” জি-২৩-র নেতারা কংগ্রেসকে ভাঙার চেষ্টা করছেন বলেও খড়্গে অভিযোগ করেন। সিব্বলের নিজের এলাকা, দিল্লির চাঁদনি চকের জেলা কংগ্রেস কমিটি আজ দল থেকে সিব্বলকে বহিষ্কারের দাবিতে প্রস্তাবও পাশ করেছে। তাঁকে ‘গদ্দার’ বলেও অভিহিত করেছেন চাঁদনি চকের কংগ্রেস নেতারা। কংগ্রেস হাই কমান্ড সূত্রেও বলা হয়, বিক্ষুব্ধদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এ সব সত্ত্বেও কংগ্রেসের নেতারা গুলাম নবির বাড়িতে হাজির হন।
বিক্ষুব্ধদের বৈঠক নিয়ে কিছু বলার আগেই পঞ্জাবের সাংসদদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েও সনিয়া আজ দলের মধ্যে অসন্তোষ টের পেয়েছেন। সাংসদরা সনিয়াকে বলেন, দলের হারের জন্য এআইসিসি-র ভারপ্রাপ্ত নেতা হরীশ চৌধুরি ও প্রার্থী বাছাই কমিটির চেয়ারম্যান দায়ী। ঘটনাচক্রে দু’জনেই রাহুল গান্ধীর আস্থাভাজন নেতা। সাংসদ জসবীর গিল বলেন, হরীশ প্রার্থী তালিকার টিকিট নিলাম করেছেন। আর এক সাংসদ বলেন, অজয় মাকেন দিল্লিতে কংগ্রেসের হাল বরবাদ করে দিয়েছেন। হাই কমান্ড তাঁকেই পঞ্জাবে পাঠিয়েছে! অমরিন্দর সিংহ মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় সিধুর সঙ্গে তাঁর বিবাদ মেটাতে খড়্গের নেতৃত্বে কমিটি তৈরি করেই পঞ্জাব কংগ্রেসের পতন ডেকে আনা হয়েছিল বলেও অভিযোগ ওঠে। এ ক্ষেত্রেও আঙুল ওঠে গান্ধী পরিবারের দিকে। বলা হয়, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে সুনীল জাখর চার বছর ধরে হিন্দু ও শিখদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করেছেন।
মঙ্গলবার রাতে উত্তরপ্রদেশ, পঞ্জাব-সহ পাঁচ রাজ্যের প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতিদের ইস্তফা দিতে বলেছিলেন সনিয়া। আশঙ্কা ছিল পঞ্জাবের প্রদেশ সভাপতি নভজ্যোত সিংহ সিধু কী করবেন, তা নিয়ে। সিধু আজ ইস্তফা দিয়েছেন। কিন্তু এই রাজ্যের এআইসিসি-র ভারপ্রাপ্ত নেতাদের কেন ইস্তফা দিতে বলা হচ্ছে না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কংগ্রেস সূত্রের বক্তব্য, সে ক্ষেত্রে উত্তরপ্রদেশের ভারপ্রাপ্ত প্রিয়ঙ্কা গান্ধী বঢরাকেও ইস্তফা দিতে বলতে হয়। প্রদেশ সভাপতিদের সরানোর পরে ওই রাজ্যগুলিতে সাংগঠনিক রদবদলের পথে এগোতে আজ সনিয়া পাঁচ রাজ্যে পাঁচ নেতাকে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। উত্তরপ্রদেশে জিতেন্দ্র সিংহ, পঞ্জাবে মাকেনকেই পাঠানো হচ্ছে।