মালয়ালি মন ভোলাচ্ছে শুধু বিয়ার। ডাঁই করা বোতলই বলে দিচ্ছে সে কথা। —নিজস্ব চিত্র
বিয়ারটা শরীরের জন্য মোটেই ভাল নয়, বুঝলেন! পেটে চর্বি জমে, সুগার বাড়ে। তার থেকে বরং হুইস্কি-রাম স্বাস্থ্যকর। ডাক্তারেরাও বলেন, এক-দু’চুমুক হার্টের জন্য ভাল— মন দিয়ে কথাগুলো বোঝাচ্ছিলেন সুজিত হরিকৃষ্ণন।
গাড়ি কোম্পানির সেলস ম্যানেজার আগে অফিস ফেরতা কোনও একটা বার-এ ঢুকে দু’এক পেগ হুইস্কি বা রামে আয়েস করতেন। উমেন চান্ডি-সরকার সেই জীবন-সুধাই কেড়ে নিয়েছে। রাজ্যে পাঁচ তারা হোটেল বাদে সব বার বন্ধ। মোড়ে শুধু টিঁকে আছে ‘ওয়াইন-বিয়ার পার্লার’। একঘেয়ে বিয়ারে মন ভরে না। এ দিকে আবার দিশি ‘কাল্লু’-টাও ঝুঁকির। তাই সরকারি ‘ফরেন লিকার’ দোকানের সামনে লাইন বাড়ছে প্রতিদিনই। সকলের তো আর পাঁচ-তারা বারে যাওয়ার রেস্ত থাকে না— হতাশা ঝরে পড়ে হরিকৃষ্ণনের গলায়।
প্রথমটায় ভেবেছিলেন, ক্ষমতায় এলে হয়তো আশার কথা শোনাবে বামেরা। কিন্তু সে গুড়ে বালি। এখন উল্টো সুর গাইছে তারাও।
সুরে সুর না মিলিয়েই বা উপায় কী! ভোট যে বড় বালাই।
যিনি রাজ্যের সব বারে তালা ঝুলিয়েছেন, সেই মুখ্যমন্ত্রী উমেন চান্ডি নিজেই তো গোড়ার দিকে রাজি ছিলেন না। তাঁর যুক্তি ছিল, পশ্চিমবঙ্গের মতোই ঋণে ডুবে রয়েছে যে রাজ্য, সেখানে মদ বিক্রির কর বাবদ ৭ হাজার কোটি টাকা হাতছাড়া করা যায় না। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি ভি এম সুধীরন মদে নিষেধাজ্ঞার দাবি তুললেও তা তখন নাকচ করে দিয়েছিলেন চান্ডি। কিন্তু ভোট যত এগোচ্ছে, দলীয় রাজনীতিতে সুধীরনকে টেক্কা দিয়ে মদে রাশ টানতে উঠে পড়ে লেগেছেন মুখ্যমন্ত্রীই।
আরও কয়েক কদম এগিয়ে উমেন চান্ডির ঘোষণা, আগামী ১০ বছরে নীতীশ কুমারের ‘বিহার-মডেল’ মেনে কেরলকেও শুখা রাজ্য বানিয়ে ছাড়বেন তিনি। বিদেশি পর্যটকদের কথা ভেবে ওয়াইন ও বিয়ার বিক্রি চালু রয়েছে রাজ্যে। ছাড় পেয়েছে সব মিলিয়ে দু’ডজন পাঁচ তারা হোটেল।
সুজিতের মতো ‘মদ্যম’-এ মজে থাকা মালয়ালিরা তাই বুক চাপড়ালেও বাড়ির গিন্নিরা কিন্তু বেজায় খুশি। মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে চান্ডির জয়গান গাইছেন তাঁরা।
আর এটাই চাপে ফেলছে কমিউনিস্টদের। প্রথমে তাঁরা বলেছিলেন, উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেওয়ায় বিশ্বাসী নয় সিপিএম। বরং সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলে সংযম তৈরি করবেন তাঁরা। মদ খাওয়া কেন খারাপ, স্কুলপাঠ্যে পড়ানো হবে তা। ২১ নয়, ২৩ বছরের কম বয়সি কাউকে যাতে মদ বিক্রি করা না হয়, খেয়াল রাখা হবে তা-ও। কিন্তু এক ধাক্কায় সাতশো বারের ঝাঁপ পড়ায় রুটি-রুজি বন্ধ হয়ে গিয়েছে অনেকের। উপায় না দেখে আত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছেন অনেকে— এই যুক্তিও দেখিয়েছিল বামপন্থীরা। এক হোটেল ব্যবসায়ীর অভিযোগ, ফের বার লাইসেন্স পাইয়ে দেবেন কথা দিয়ে এক কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছেন অর্থমন্ত্রী কে এম মানি। বিতর্কের জেরে পদ ছাড়তে হয় তাঁকে। একই ধরনের অভিযোগে নাম জড়ায় কেরলের আরও তিন মন্ত্রীর।
বেকায়দায় পড়ে কংগ্রেসের পাল্টা প্রচার— হোটেল ব্যবসায়ী, বার-মালিক, মদ কোম্পানিগুলোর মতো ‘লিকার-লবি’-র কথায় চলছে সিপিএম। ভোটের মুখে মদ-নীতি এ বার খোলসা করুক বামেরা। কিন্তু তার পরও কিছু দিন দোলাচলে ছিলেন সিপিএম নেতারা। শেষে দলের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি দিল্লি থেকে কেরলে ভোট প্রচারে এসে জানিয়ে দেন, ক্ষমতায় এলে কংগ্রেসের মদ-নীতি পাল্টাবেন না তাঁরাও।
সিপিএমের সাধারণ সম্পাদকের এই বার্তার পর মুচকি হাসছেন মুখ্যমন্ত্রী উমেন চান্ডি। তাঁর দাবি, লড়াইয়ের এই রাউন্ডে জিতে গিয়েছেন তিনিই।
কিন্তু ভোট যুদ্ধের বাকি পথটা কি এতটাই মসৃণ? তা হলে সুজিত হরিকৃষ্ণনের মতো ‘রাম-ভক্ত’দের অভিশাপ কোথায় যাবে? মাছভাজার সঙ্গতে ওল্ড পোর্ট রামের স্বাদ স্ট্রং বিয়ার দিয়ে মেটাতে হচ্ছে যাঁদের, জীবন-সুধা কেড়ে নেওয়ার বদলা হিসেবে উমেনের গদিই উল্টে দিতে চান তাঁরা। সুজিত তো সরাসরিই বলছেন, অনেক হয়েছে, কংগ্রেসের এ বার যাওয়া উচিত। বামেদের উপরেও তাঁর রাগ কম নয়।
‘মদ্যম’ প্রিয় মালয়ালিদের মন পেতে তাই মাঝামাঝি অবস্থান নিয়েছে বিজেপি। দলের রাজ্য সভাপতি কে রাজাশেখরন বলেছেন, ধাপে ধাপে মদ্যপান কমিয়ে আনার পক্ষে তাঁরা। প্রথমে মদ কেনায় ঊর্ধ্বসীমা, তার পর নতুন মদের দোকান বা বারের লাইসেন্স বন্ধ করা— ক্রমশ এই ভাবেই এগোবেন তাঁরা। বিজেপির আরও যুক্তি, রাজ্য সরকারের বেভারেজ কর্পোরেশন মদ তৈরি করছে। সরকারি দোকান থেকে তা বিক্রিও করছে। তা হলে খামোখা বার বন্ধ করে লাভটা কী!
সব দলের নেতারাই মানছেন, কালকের ভোট শুধু আর কাস্তে-হাতুড়ি-হাত-পদ্মের লড়াইয়ে আটকে নেই। হুইস্কি-রাম, ওয়াইন-বিয়ারে মজে গিয়েছে রীতিমতো। মৌতাত উপেক্ষা করে কংগ্রেসের সিদ্ধান্তে কি সিলমোহর দেবেন কেরলবাসী, উত্তর বন্দি বিয়ার বোতলেই।