দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেন। ছবি: পিটিআই
দুর্ঘটনার কবলে পড়ল জগদলপুর থেকে ভুবনেশ্বরগামী হিরাখন্দ এক্সপ্রেস। আর তার তদন্তে নেমে দুর্ঘটনার প্রাথমিক কারণ হিসেবে লাইন ভাঙার বিষয়টিতেই আপাতত গুরুত্ব দিচ্ছেন তদন্তকারীরা। তবে নাশকতার তত্ত্বও উড়িয়ে দেননি তাঁরা।
শনিবার রাতে অন্ধ্রপ্রদেশের ওয়ালটেয়ার ডিভিশনের কুনেরু স্টেশনের কাছে হিরাখন্দ এক্সপ্রেসের ৯টি কামরা লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে। মারা গিয়েছেন ৩৯ জন যাত্রী। জখম ৬৯ জন। তাঁদের মধ্যে ১৩ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আহতরা স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি। মৃতদের পরিবার ও আহতদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
শোকপ্রকাশ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তথা প্রাক্তন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। টুইটে তাঁর অভিযোগ, ‘‘ইদানীং রেলকে কম গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। রেলের বাজেট কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং সুরক্ষা ও নিরাপত্তার সঙ্গে আপস করা হচ্ছে।’’
তবে এটা দুর্ঘটনা না নাশকতা, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে ধোঁয়াশা। কারণ যেখানে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে, অন্ধ্র-ওড়িশার সীমানায় অবস্থিত সেই কুনেরু এলাকা বরাবরই মাওবাদী-অধ্যুষিত। ২০০৫ সালে এই কুনেরু স্টেশনের কাছেই একটি ট্রেনে হামলা চালিয়ে লুঠ চালিয়েছিল ১০ মাওবাদীর একটি দল। তাদের সঙ্গে গুলিযুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন ৪ আরপিএফ-ও। নাশকতার তত্ত্বকে উস্কে দিয়েছেন হিরাখন্দ এক্সপ্রেসের চালকও। রেল সূত্রে খবর, চালক জানিয়েছেন, হিরাখন্দের ৯টি কামরা বেলাইন হওয়ার আগে একটি বিস্ফোরণের শব্দ পান তিনি। তা ছাড়া হিরাখন্দ এক্সপ্রেস ওই লাইন দিয়ে যাওয়ার আগে একটি মালগাড়ি গিয়েছিল। তার পর নিয়ম মাফিক লাইন পরীক্ষাও করা হয়। লাইনে ফাটল থাকলে তা তখনই ধরা পড়ার কথা। ফলে মাওবাদী নাশকতার আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না রেলকর্তাদের একাংশ। তবে ওড়িশার ডিজিপি কে বি সিংহের দাবি, ‘‘দুর্ঘটনায় মাওবাদীদের হাত নেই।’’
প্রাথমিক ভাবে লাইন ভেঙে দুর্ঘটনার উপরে জোর দিচ্ছেন তদন্তকারীরাও। তাঁদের বক্তব্য, এ বছর শীতের শুরু থেকেই প্রতিদিন যে ভাবে আবহাওয়ার তাপমাত্রা নামা-ওঠা করছে, তাতে রেল লাইনের ইস্পাতের ভিতরের আণবিক গঠনে তারতম্য হচ্ছে। তার জেরে তৈরি হচ্ছে চিড় বা ফাটল। আর সেখান থেকেই ঘটছে দুর্ঘটনা।
সেই চিড় বা ফাটল কি দেখভাল করা হচ্ছে না? রেলকর্তারা জানাচ্ছেন, মাসে একবার এক্স-রে মেশিন দিয়ে ফাটল দেখা এবং প্রতি রাতে তিন বার পায়ে হেঁটে লাইন পরীক্ষা করা হয়। এটাই দস্তুর। পায়ে হেঁটে ওই পরীক্ষা চালান রেলের ট্র্যাকম্যানেরা (লাইন পরীক্ষক)। পরীক্ষার পরে তা খাতায় লিপিবদ্ধ করা হয়। স্টেশন মাস্টার সেই খাতা দেখে ট্রেন এগোনোর অনুমতি দেন। প্রতি রাতেই একটি স্টেশন থেকে আর একটি স্টেশন পর্যন্ত রাত ১১টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত তিন বার এই ভাবে পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু তার পরেও লাইন ভাঙার ঘটনা চোখে না পড়ায় দুর্ঘটনায় পড়ছে ট্রেন।
রেলকর্তারা জানাচ্ছেন, এখন প্রতিটি রুটেই চলছে অতিরিক্ত ট্রেন। আগে দু’টি ট্রেনের মধ্যে অনেকটা সময় থাকায় লাইন ভাঙলে তা ধরা পড়ত। ফলে দুর্ঘটনা আটকানো যেত। কিন্তু এখন ট্রেন বাড়ায় দু’টি ট্রেনের মধ্যে সময়ের ব্যবধান কমে গিয়েছে।
ফলে পরীক্ষা করতে করতেই ঘটে যাচ্ছে দুর্ঘটনা।
ফলে দুর্ঘটনার আসল কারণ কী, রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভুর নেতৃত্বে তা খতিয়ে দেখবেন পূর্ব-উপকূল রেলের সেফটি কমিশনার। তা ছাড়া, দুর্ঘটনার পিছনে নাশকতার গন্ধ থাকায় উদ্বিগ্ন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকও। বিশেষ করে গত বছরের শেষে কানপুরের কাছে শিয়ালদহ-অজমের এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনায় পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই এবং ডন দাউদ ইব্রাহিমের হাত থাকার বিষয়টি সামনে আসায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ জানিয়েছেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকও হিরাখন্দ দুর্ঘটনার তদন্ত করবে। সূত্রের খবর ইতিমধ্যেই এনআইএ শিয়ালদহ-অজমের এক্সপ্রেস এবং ইনদওর-পটনা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার তদন্ত করছে। তার মধ্যে হিরাখন্দ এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার তদন্তও অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে। হিরাখন্দ দুর্ঘটনার তদন্ত করবে অন্ধ্রপ্রদেশ সরকারও।
হিরাখন্দ এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হয় শনিবার রাত সওয়া ১১টা নাগাদ। আচমকাই প্রচণ্ড শব্দ করে ট্রেনটি হেলতে-দুলতে মাটির উপর দিয়ে অনেকটা এগিয়ে থেমে যায়। নিভে যায় কামরার আলোও। যাত্রীদের অনেকেই অন্ধকার কামরায় হাতড়ে হাতড়ে দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কামরাগুলি থেকে জখম যাত্রীদের আর্তনাদ ও কান্না ভেসে আসছিল। স্থানীয় লোকজন টর্চ এনে উদ্ধার কাজ শুরু করেন।
কিছু ক্ষণের মধ্যেই ঘটনাস্থলে চলে আসে রেলের অ্যাক্সিডেন্ট রিলিফ ট্রেন। সঙ্গে আসে মেডিক্যাল রিলিফ ট্রেনও। চলে আসে ২৫টি অ্যাম্বুল্যান্স। এক ঘণ্টার মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছয় জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীও। শুরু হয়ে যায় উদ্ধার কাজ।
রবিবার সকালে সুরেশ প্রভু এবং রেলবোর্ডের চেয়ারম্যান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। নিহতদের পরিবারকে ২ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেন সুরেশ প্রভু। আহতদের দেওয়া হবে ৫০ হাজার টাকা করে। ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছেন অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নায়়ডুও। মৃত অন্ধ্রের বাসিন্দাদের পরিবারকে ৫ লক্ষ টাকা করে দেওয়া হবে। পূর্ব উপকূল রেল সূত্রের খবর, এই দুর্ঘটনার জন্য বেশ কিছু ট্রেন বাতিল করা হয়েছে। ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বহু ট্রেন।