নাহারলাগুনের টোচি টাকার কমিউনিটি হলে অধিবেশন করছেন রাজ্যপাল জ্যোতির্ময় রাজখোয়া। বুধবার। — নিজস্ব চিত্র।
চিন সীমান্ত লাগোয়া দেশের অন্যতম স্পর্শকাতর রাজ্য অরুণাচল প্রদেশ। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে রাজ্যপালের দ্বৈরথে সেখানে এ বার আরও তীব্র হল সাংবিধানিক সঙ্কট।
মুখ্যমন্ত্রী নাবাম টুকির বিরুদ্ধে কংগ্রেসের গরিষ্ঠসংখ্যক বিধায়কের অসন্তোষ দেখে রাজ্যপাল জ্যোতির্ময় রাজখোয়া যখন আজ তড়িঘড়ি বিধানসভা ডাকার সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন বিধানসভাতেই তালা ঝুলিয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী! কিন্তু রাজ্যপালও যেন ধনুক ভাঙা পণ করেছেন। বিধানসভায় তালা দেখে পাশের কমিউনিটি হলেই অস্থায়ী সভা বসানোর নির্দেশ দিলেন তিনি। তার পর গরিষ্ঠসংখ্যক বিধায়কের ভোটে প্রথমেই বিধানসভার স্পিকারকে সরিয়ে দেওয়া হল। আলঙ্কারিক সাংবিধানিক পদে থেকে রাজ্যপালের এই ‘অতিসক্রিয় রাজনৈতিক আচরণ’-কে কেন্দ্র করে এর পর বিধানসভার সামনেই খণ্ডযুদ্ধ চলল কংগ্রেস-বিজেপি বিধায়কদের।
এমনিতে উত্তর-পূর্বের রাজনীতির আঁচ সচরাচর দিল্লিতে পড়ে না। কিন্তু কেন্দ্রে মোদী সরকার গঠনের পরে রাজ্যে রাজ্যে রাজ্যপালদের অতিসক্রিয়তা ও রাজনৈতিক মন্তব্য করা নিয়ে এমনিতেই ক্ষেপে ছিল কংগ্রেস। তার ওপর ন্যাশনাল হেরাল্ড বিতর্ক ও দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবালের সচিবালয়ে সিবিআইয়ের হানার প্রেক্ষাপটে অরুণাচলের ঘটনাকেও রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার করতে ছাড়লেন না সনিয়া-রাহুল। তাঁদের মূল বক্তব্য, অ-বিজেপি রাজ্যগুলোতে রাজ্যপালদের দিয়ে প্রশাসনকে ক্রমাগত বিব্রত করার ও সরকারকে অস্থির করার চেষ্টা চালাচ্ছে বিজেপি। সাংবিধানিক পদে থেকে রাজ্যপালদের এ ভাবে অসাংবিধানিক আচরণ বরদাস্ত করা যায় না।
সেই অভিযোগ করে আজ সংসদের দুই সভায় যেমন বিক্ষোভ দেখায় কংগ্রেস, তেমনই দলীয় সাংসদদের এক প্রতিনিধি দলকে নিয়ে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করেন সনিয়া-রাহুল। তার পর সনিয়া ও রাজ্যসভায় বিরোধী দলনেতা গুলাম নবি আজাদ বলেন, ‘‘অরুণাচলে রাজ্যপাল বিজেপির রাজ্য সভাপতির মতো কাজ
করছেন।’’ রাতে রাজ্য সরকারও বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, রাজ্যপাল কেন্দ্র সরকারের হয়ে রাজ্যে নির্বাচিত সরকার ফেলার চক্রান্তে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। স্পিকার থাকতেও বিধানসভার বাইরে ডেপুটি স্পিকারকে দিয়ে অধিবেশন করিয়ে অসাংবিধানিক কাজ করেছেন রাজখোয়া। স্পিকার ১৪ জন বিধায়ককে বহিষ্কার করেছেন। সেই নির্দেশ খারিজ করার অধিকার
ডেপুটি স্পিকারের নেই। আজকের অধিবেশন পুরোপুরি বেআইনি। সেখানে নেওয়া সিদ্ধান্ত ও প্রস্তাবের কোনও ভিত্তি নেই।
স্পিকার নাবাম রিবিয়াও বলেন, ‘‘বিধানসভা, গণতন্ত্র ও ভারতীয় সংবিধানকে প্রহসনে পরিণত করেছেন রাজ্যপাল। আমি মুখ্যমন্ত্রী ও চিফ হুইপের আবেদন পাওয়ার পরেই ১৪ জন বিধায়ককে (যাঁদের মধ্যে ডেপুটি স্পিকারও রয়েছেন) বহিষ্কার করেছি। আমার বিরুদ্ধে আনা অপসারণ প্রস্তাবের বিচার করবে বিধানসভার কার্যনির্বাহী উপদেষ্টা কমিটি (বিএসি)।’’ স্পিকারের আরও দাবি, ‘‘ডেপুটি স্পিকারকে আগেই বরখাস্ত করা হয়েছে। ফলে তাঁর অধিবেশন চালানোর এক্তিয়ারই নেই। পুরো অধিবেশনই অসাংবিধানিক।’’ তবে বিজেপির রাজ্য সভাপতি টাই টাগাকের দাবি, ‘‘কংগ্রেসের ঘরোয়া কোঁদলে আমাদের কোনও হাত নেই।’’
মজার ব্যাপার, বিধানসভা অধিবেশন হবে কি না, কাল রাত পর্যন্ত ঠিক ছিল না। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের এক মাস আগে হঠাৎই আজ বিধানসভার অধিবেশন ডাকার কথা ঘোষণা করেন রাজ্যপাল জ্যোতিপ্রসাদ রাজখোয়া। তিনি জানান, অধিবেশনের প্রথমেই স্পিকারের অপসারণ নিয়ে আলোচনা হবে। রাজ্যপাল যে এমন পদক্ষেপ করতে পারেন তা কংগ্রেস আগেই আঁচ করেছিল। তাই গতকাল সন্ধ্যায় মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে টুকি রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করে জানিয়ে দিয়েছিলেন সংবিধান ও অরুণাচলপ্রদেশ বিধানসভার কার্যাবলী সংক্রান্ত নিয়ম অনুযায়ী রাজ্যপাল এ ভাবে এক তরফা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। তাঁরা ‘অসাংবিধানিক’ ভাবে ডাকা বিধানসভা অধিবেশনে যাবেন না। এমনকী, বৈঠকে রাজ্যপালকে ‘দেখে নেওয়া’র হুমকিও দেওয়া হয়।
রাজ্যপাল কিন্তু নিজের নির্দেশে অনড় থাকেন। তাই বিধানসভার অধিবেশন হচ্ছে না বলে স্পিকার নাবাম রিবিয়া জানিয়ে দেওয়ার পরেও এক প্রকার জোর খাটিয়ে সভা শুরুর চেষ্টা হয়। তার নেতৃত্ব দেন ডেপুটি স্পিকার টি এন থংডক। তিনি জানান, রাজ্যপালের ঘোষণা মতোই অধিবেশন বসবে।
প্রসঙ্গত, মুখ্যমন্ত্রী নাবাম টুকির বিরুদ্ধে থাকা ২১ জন কংগ্রেস বিধায়ক ও দুই নির্দল বিধায়ককে দলে টেনে চলতি অধিবেশনেই সরকার ফেলতে তৈরি হচ্ছিল বিজেপি। ৬০ সদস্যের বিধানসভায় কংগ্রেসের বিধায়কসংখ্যা ৪৭। বিজেপির ১১। দিল্লিতে বিজেপি নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনায় অরুণাচলে সরকার ফেলার নীল-নকশা তৈরি করে ওই বিধায়করা সোমবার রাতে ইটানগরে ফেরেন। কিন্তু গত রাতে বিধানসভা থেকে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয় কংগ্রেসের ১৪ জন বিক্ষুব্ধ বিধায়ককে দলত্যাগ বিরোধী আইনের অধীনে বহিষ্কার করা হচ্ছে এবং ওই আসনগুলো খালি বলে গণ্য করা হবে। এই সিদ্ধান্তের ফলে কংগ্রেসের বিধায়ক সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৩ জন। অবশ্য দলত্যাগ না করেও ওই আইনে বহিষ্কারের নির্দেশ মানতে রাজি নন বিক্ষুব্ধরা। তাঁদের দাবি, এ ভাবে বিধানসভার সচিব বিবৃতি দিয়ে বিধায়কদের বহিষ্কার করতে পারেন না। আজ সকালে কংগ্রেসের বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর বিধায়ক এবং বিজেপি বিধায়করা বিধানসভায় ঢুকতে গিয়ে দেখেন প্রবেশ পথে তালা ঝুলছে। এর পরেই শাসক বনাম বিরোধীদের কাজিয়া শুরু হয়। আসরে নামেন খোদ রাজ্যপাল। প্রথমে তিনি
মুখ্য সচিবকে বিধানসভা খোলার নির্দেশ দেন। কিন্তু মুখ্যসচিবের কথা মানেনি মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে পাহারায় মোতায়েন পুলিশবাহিনী।
এ পরেই বিধানসভার পাশে নাহারলাগুনের টোচি টাকার কমিউনিটি হল ভাড়া নিয়ে বেলা ২টো থেকে অধিবেশন শুরু করেন রাজখোয়া। অধিবেশন চালাবার ভার দেন ডেপুটি স্পিকারের উপর। অধিবেশনে হাজির ছিলেন ১১ জন বিজেপি বিধায়ক, ২ নির্দল বিধায়ক এবং গত রাতে বহিষ্কৃত ১৪ জন বিধায়ক-সহ ২১ জন বিক্ষুব্ধ কংগ্রেস বিধায়ক। ডেপুটি স্পিকার ওই বিধায়কদের বহিষ্কারের নির্দেশ নস্যাৎ করে দেন। উল্টে, আজকের অধিবেশনে হাজির ৬০ বিধায়কের মধ্যে ৩৪ জন বিধায়ক একমত হয়ে স্পিকার তথা মুখ্যমন্ত্রীর ভাই নাবাম রিবিয়াকেই স্পিকার পদ থেকে অপসারিত করে দেন। রিবিয়া অবশ্য পাল্টা জানিয়েছেন, ওই সিদ্ধান্ত তিনি মানবেন না।
শাসক কংগ্রেসের পাশাপাশি ছাত্র সংগঠন আপসুও রাজ্যপালের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিধানসভার সামনে বিক্ষোভ দেখায়। পাথর ছোঁড়া হয়। তাতে রাজধানী শহরে কার্যত বন্ধ-সদৃশ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। শাসক দলের বিরুদ্ধে যাতে জনমত ছড়াতে
না পারে, সেই জন্য গতকাল রাত থেকেই রাজ্যে ইন্টারনেট ও এসএমএস পরিষেবাও বন্ধ করে দিয়েছে রাজ্য সরকার।
এ দিকে বিজেপি ও বিক্ষুব্ধ কংগ্রেস বিধায়করা দাবি করছেন, মুখ্যমন্ত্রী বিধায়কদের দলে টানতে কয়েকশো কোটি টাকার টোপ দিচ্ছেন। বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর নেতা কালিখো পুলকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব এবং ১০০ কোটি টাকার টোপ দেওয়া হয়েছে। বিক্ষুব্ধ বিধায়কদের সাতজনকে দলে টানতেও শতাধিক কোটির টোপ দিয়েছে কংগ্রেস।
সব মিলিয়ে চিন সীমান্ত ঘেঁষা স্পর্শকাতর রাজ্যটিতে এখন অস্থির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক সূত্রের মতে, পরিস্থিতি খুবই তরল অবস্থায় রয়েছে। তবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই কেন্দ্রে যে দল ক্ষমতায় থাকে উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে তাঁদের ছড়ি ঘোরানোর জোর থাকে! তাই রাজ্যপালের সমালোচনা যাই হোক, নাবাম টুকির আসন এখন টলমল।