লালকেল্লায় নরেন্দ্র মোদীর ভাষণ।
‘আত্মনির্ভর ভারত’ গড়ার ডাককে স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লার প্রাচীর থেকে দেওয়া বক্তৃতার মূল সুর হিসেবে বেঁধেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তার জন্য প্রয়োজনে ‘আত্মাহুতি’র কথাও বলেছেন তিনি। কিন্তু কার্যত অনুচ্চারিত থেকে গিয়েছে, পড়াশোনার পাঠ শেষে যে ভিতের উপরে দাঁড়িয়ে যুব সমাজ স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখে, সেই কাজের সুযোগ তৈরির কথা!
কংগ্রেস-সহ বিরোধী শিবিরের কটাক্ষ, ফি বছর দু’কোটি কাজের সুযোগ তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিল্লির মসনদ দখল করেছিলেন মোদী। এখন সেই নতুন চাকরি তৈরির কথা, তাঁর নতুন ভারতের স্বপ্ন ফেরিতেও গরহাজির! তা-ও এমন সময়ে, যখন বিধ্বস্ত অর্থনীতিতে বেকারত্বের হার চড়া। শুধু করোনার কামড়েই কাজ খুইয়েছেন প্রায় ১৪ কোটি মানুষ। সরকারের পরিকল্পনা মাফিক পরিকাঠামোয় বিপুল বিনিয়োগ এলে, কাজের সুযোগ তৈরির দাবি প্রধানমন্ত্রী করেছেন ঠিকই। কিন্তু সেই লগ্নি কোথা থেকে আসবে, তা-ও অস্পষ্ট। শনিবার স্বাধীনতা দিবসের বক্তৃতায় মোদী মেনে নিয়েছেন, সঙ্কটের খাদ থেকে অর্থনীতিকে টেনে তুলতে পরিকাঠামোয় টাকা ঢালা ছাড়া গতি নেই। দাবি করেছেন, ওই খাতে ১১০ লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগের জন্য প্রায় ৭,০০০ প্রকল্প চিহ্নিত করার কাজ সম্পূর্ণ। তাঁর কথায়, “সবসময়ই বলা হয়, এমন সঙ্কটের মুহূর্তে আর্থিক কর্মকাণ্ডে গতি ফেরাতে পরিকাঠামোয় টাকা ঢালা জরুরি। কারণ, তাতে অর্থনীতির চাকায় গতি ফেরে। তৈরি হয় কাজের সুযোগ।”
বিরোধীরা বলছেন, ওই টাকা আসবে কোথা থেকে? এই অনিশ্চিত সময়ে বড় লগ্নির পথে হাঁটতে রাজি খুব কম বেসরকারি সংস্থা। অর্থনীতির চাকায় গতি ফেরাতে সরকার কি বিনিয়োগ করবে? সরকারি ব্যয়বৃদ্ধি ছাড়া অর্থনীতির হাল ফেরানো যে কার্যত অসম্ভব, সে কথা বার বার বলছেন দেশ-বিদেশের প্রথম সারির অর্থনীতিবিদেরা। যে কারণে রাজকোষ থেকে মোটা ব্যয়ের পরিবর্তে ঋণের সুবিধায় ঠাসা ২০ লক্ষ কোটি টাকার ত্রাণ প্রকল্প খুশি করতে পারেনি তাঁদের। বিরোধীদের প্রশ্ন, খোদ প্রধানমন্ত্রী পরিকাঠামোয় বিনিয়োগে জোর দেওয়ার পরে ওই খাতে কি টাকা ঢালবে তাঁর সরকার? না হলে তো কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা স্রেফ ‘কথার কথাই’ থেকে যাবে।
প্রধানমন্ত্রী হামেশাই বলে থাকেন, “শুধু চাকরিপ্রার্থী হয়ে থাকা নয়, নতুন প্রজন্ম নিজেরাই নতুন কাজের সুযোগ তৈরির ক্ষমতা রাখে।” বিরোধীরা জানতে চান, তবে কি কর্মসংস্থানের কথা ভুলেই যেতে বলছে সরকার? প্রত্যেককে দাঁড়াতে বলছে নিজে ব্যবসা করে? সেটাই কি ‘আত্মনির্ভরতা’র মন্ত্র! তাঁদের অভিযোগ, প্রথমত সকলের পক্ষে ব্যবসা করা সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, নতুন ব্যবসার পক্ষেও মাথা তোলা সহজ হয় অর্থনীতি অনুকূল হলে। কেন্দ্র যদি আগে পরিকাঠামোয় সরকারি ব্যয়বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনীতিতে প্রাণ ফেরানোর চেষ্টা না-করে, তা হলে নতুন ব্যবসাই বা মাথা তুলবে কী ভাবে?
বহু সর্বভারতীয় কর্মী সংগঠনের আক্ষেপ, প্রধানমন্ত্রী নতুন কাজের সুযোগ তৈরির কথা সে ভাবে বলেননি। তেমনই মুখে আনেননি খাদের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা শ্রমিকদের প্রসঙ্গ। তিনি বলেছেন, “কোনও দেশের বৈভব, উন্নতি, প্রগতি নির্ভর করে তার কর্মশক্তির উপরে।” কিন্তু এ দেশে করোনার জেরে কাজ হারানো কর্মী, চরম বিপাকে পড়া পরিযায়ী শ্রমিকদের সুরাহার জন্য আগামী দিনে সরকার আর কী করবে, তা তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট নয়। দিশা নেই বেকারত্বের হার দ্রুত নামিয়ে আনার বিষয়েও। যদিও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নীতিন গডকড়ী আজ দাবি করেছেন, ছোট-মাঝারি শিল্পের রফতানি আগামী ৫ বছরে ৬০ শতাংশে পৌঁছলে, ৫ কোটি কাজের সুযোগ তৈরি হবে এই ক্ষেত্রে।
কাজের আকাল নিয়ে কথা উঠলেও, বক্তৃতায় আগাগোড়া অবশ্য আত্মনির্ভরতার উপরেই জোর দিয়েছেন মোদী। কখনও আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে উৎপাদনে স্বাবলম্বী হওয়ার ডাক দিয়েছেন, তো কখনও মনে করিয়েছেন স্থানীয় পণ্যের জন্য গলা ফাটানোর প্রয়োজনীয়তা। কৃষি, পরিকাঠামো, শিক্ষা, আর্থিক ক্ষেত্রে ঝোড়ো সংস্কার ওই স্বাবলম্বনকে নিশানা করে করা হচ্ছে বলেও প্রধানমন্ত্রীর দাবি। বিরোধীদের বক্তব্য, এক সময়ে এ ভাবে ঢাক-ঢোল পিটিয়েই ‘মেক ইন ইন্ডিয়ার’ প্রচারে নেমেছিল মোদী সরকার। কিন্তু তা সাফল্যের মুখ না-দেখায় এখন সেটিকেই ‘আত্মনির্ভর ভারত’-এর নতুন মোড়কে পেশ করতে মরিয়া মোদী। কিন্তু শুধু মোড়ক বদলে কাজের সুযোগ তৈরি হবে কী ভাবে, সেই প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা।